বারাসাত এলাকায় শিশু চুরি করে ধরা পড়েছেন দাবি করে এক মহিলার ছবি ও ভিডিওসহ 'সতর্কতামূলক' কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বর্তমানে ভাইরাল সমাজমাধ্যমে।
বুম বারাসতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়ার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয় দাবিটি ভুয়ো। প্রতীক্ষা আমাদের জানান ছবিতে দেখতে পাওয়া ওই মহিলা কোন ছেলেধরা নন বরং বারাসতের এক খুনের ঘটনায় অভিযুক্তের ছড়ান গুজবের শিকার হন তিনি।
বারাসতে এক শিশুর প্রথমে নিখোঁজ ও পরে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছুদিন আগেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় কাজীপাড়া। শিশু মৃত্যুর সেই ঘটনার পর এলাকা থেকে ছেলেধরা এসে বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে দাবি করে সেখানে ছড়িয়ে পরে গুজব। সমাজমাধ্যমেও পরে সেই গুজব ছড়িয়ে পড়লে তাকে কেন্দ্র করে সন্দেহের বশে গণপিটুনির স্বীকার হন কয়েকজন। ভাইরাল সেই দাবির সত্যতা যাচাই করার আগেই জনতার হাতে ধরা পড়া ওই মহিলার ছবি ও ভিডিও ছেলেধরা দাবিতে ছড়িয়ে পরে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ান ওই গ্রাফিকটিতে লেখা হয়, "জরুরী ঘোষণা বাবা ও মায়েরা সতর্ক হন ছবিতে যেই মহিলা কে দেখতে পাচ্ছেন তাকে কেও কোথাও দেখে থাকলে অবশ্যই কন্ট্যাক্ট করুণ, এই মহিলা 5 জোন বাচ্চাকে চুরি করেছে, বারাসাত, ঘোলা কাজীপাড়া, একদিলশাহ রোড উত্তরহাট খেলার মাঠের সামনে থেকে আরও একটা 11 বছরের এর বাচ্চাকে চুরি করেছেন!"
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে ও তার আর্কাইভ দেখতে এখানে।
বাচ্চা চুরি করে ধরা পড়েছেন দাবি করে ওই মহিলাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখার ভিডিও পোস্ট করেন অনেকে।
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে ও তার আর্কাইভ দেখতে এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম ভাইরাল পোস্টে থাকা দাবি যাচাই করতে সম্পর্কিত কীওয়ার্ড সার্চ করায় ১৭ জুন, ২০২৪ তারিখে বারাসাত পুলিশের এক্স হ্যান্ডেল থেকে করা এক পোস্ট খুঁজে পায়।
ওই পোস্টে ভাইরাল গ্রাফিকে থাকা তথ্য বিভ্রান্তিকর ও গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ করে লেখা হয়, "সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ান গুজবে বারাসাতে এক মহিলা শিশু ও অঙ্গ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। শিশুটির ময়নাতদন্তের পর মেডিকেল অফিসার নিশ্চিত করেছেন যে এটি অঙ্গ পাচারের ঘটনা নয়। দয়া করে এসব মিথ্যা খবর ছড়াবেন না।"
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে ও তার আর্কাইভ দেখতে এখানে।
ঘটনাটি সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে এরপর বুমের তরফে বারাসতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হয়। প্রতীক্ষা আমাদের দাবিটি ভুয়ো বলে জানান বারাসাতে হওয়া এক খুনের ঘটনা ঢাকতে ছড়ান হয় ছেলেধরার এই গুজব।
বারাসত পুলিশ সুপার বুমকে বলেন, "সম্প্রতি বারাসাতের কাজীপাড়ায় এক শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। তদন্তে জানা যায় শিশুটির কাকা, নাম এঞ্জের, শিশুটিকে হত্যা করে। ৯ জুন রবিবার শিশুটিকে খুন করা হয়। শিশুটিকে হত্যার পরের দিন অর্থাৎ সোমবার থেকে হত্যাকারী খুনের ঘটনা ঢাকতে ছেলেধরার বাচ্চা তুলে নিয়ে যাওয়ার গুজব ছড়াতে শুরু করে। খুনের ঘটনার তিন-চারদিন পর আমরা যখন শিশুটির দেহ উদ্ধার করি, ততদিনে এই ছেলেধরার গুজব সত্যি কিনা বা এব্যাপারে পুলিশের বয়ান না জেনেই ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের দৌলতে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এরপর যখন অভিযুক্তকে ধরি ও সে স্বীকারোক্তি দেয় - ততদিনে ৭-৮ দিন হয়ে গেছে।"
ছেলেধরার গুজব থেকে কীভাবে এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে তা জানতে চাওয়ায় প্রতীক্ষা বলেন, "অভিযুক্ত প্রথমে স্থানীয় অঞ্চলে এই গুজব ছড়াতে শুরু করে। ওই অঞ্চলে ভবঘুরে এক মহিলাকে বাচ্চা চোর বলে চিহ্নিত করে সে এই গুজব ছড়ায়।"
এরপর আমরা পুলিশ সুপারকে ভাইরাল গ্রাফিক ও ভিডিওতে থাকা মহিলা এবং তাকে শিশুচোর বলা দাবির সত্যতা জানতে চাইলে তিনি বলেন পার্বতী দাস নামের ওই মহিলা আসলে নির্দোষ।
প্রতীক্ষা বলেন, "মহিলাটির নাম পার্বতী দাস, বয়স ৪৫ বছর, বাড়ি নদিয়ার চাকদহে। ওই গুজবের কারণে কাজীপাড়ার লোকজন প্রথমে তাকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করে। খুনের ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০০-৬০০ মিটার দূরেই এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। সব সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই হয়। প্রথমে এই গুজব কীভাবে ছড়াল তা বুঝতে না পারা গেলেও আমরা যখন কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডমিনসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করি, তারা আমাদের জানায় শুধুমাত্র অন্যের মুখ থেকে শুনে তারা এই গুজব ছড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই কাজীপাড়ার ওই অঞ্চলে অভিযুক্তের কথা থেকেই এই গুজব ছড়ায়। এই গণপিটুনির ঘটনার পরেও আরও ৩-৪ জায়গায় শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই এমন মারধরের ঘটনা ঘটে।"
গুজব প্রতিরোধে বারাসাত পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে জানাতে প্রতীক্ষা বুমকে বলেন, এসম্পর্কিত তারা এখনও অবধি প্রায় ৫৫-৫৭ টি সোশ্যাল মিডিয়ায় করা পোস্ট পেয়েছেন এবং পুলিশের তরফে উক্ত ব্যক্তিদের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। "ফেসবুককেও আমরা জানিয়েছি এব্যাপারে", বলেন পুলিশ সুপার।
গুজবের ব্যাপারে সচেতন করতে বারাসাত পুলিশের তরফে স্কুলের সামনে লিফলেট বিলি করা হয়। টিভি৯ বাংলার সেই সংবাদ প্রতিবেদন নিচে দেখা যাবে।