সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত জেলার একটি ভিডিও যেখানে এক মহিলাকে জনগণের হাতে হেনস্থা হতে দেখা যাচ্ছে ভুয়ো সাম্প্রদায়িক দাবি সহ ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে ভিডিওটিতে এক হিন্দু মহিলার উপর মুসলমানদের নৃশংসভাবে অত্যাচারের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
একই ঘটনার আরও একটি ভিডিওও অন্য এক ভুয়ো দাবিসহ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। সেখানে দাবি করা হয়েছে এক মহিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে আসলে বাংলার স্থানীয় বাসিন্দারা আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পুলিশ অফিসারদের উপর হামলা শুরু করে।
বুম যাচাই করে দেখে দুটি দাবিই ভুয়ো। আমরা বারাসাতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নিশ্চিত করেন ভিডিওগুলি পুরনো এক ঘটনার দৃশ্য; ওই ঘটনায় এলাকায় ভিত্তিহীন শিশু অপহরণের গুজব ছড়ালে জনতা এক নির্দোষ মহিলাকে মারধর করে। ঝারখারিয়া আরও জানান এই ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক নেই।
উভয় ভিডিওতেই প্রথমে একদল লোক ও পুলিশকে একজন মহিলাকে রাস্তায় ধাওয়া করতে দেখা যায়। ভিডিওর পরবর্তী অংশে এক পুলিশ ভ্যানের সামনে একদল লোক ওই মহিলাকে আক্রমণ করে, যার ফলে পুলিশের গাড়ির সামনের কাঁচটিও ভেঙে যায়।
সতর্কবার্তা: ভিডিওতে নৃশংসতা দৃশ্যমান। দর্শকদের সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধ করা হল।
ভাইরাল ভিডিওটির ক্যাপশন হিসেবে লেখা হয়, "পশ্চিমবঙ্গে এখন সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল। এর প্রধান কারণ ঘৃণ্য উপায়ে কোটি কোটি টাকা তছরুপ করতে সাহায্য করতে। এটা মনিপুরে নয় এটা পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত, নারীর সন্মান আজ ভূলুণ্ঠিত মমতা ব্যানার্জি'র আদরের রত্ন জেহাদীদের হাতে।"
এরকম একটি পোস্ট দেখুন এখানে এবং আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ফেসবুকেও একই ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশন হিসাবে লেখা হয়েছে, "এটা মনিপুরে নয় এটা পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত, তাই হয়তো প্রতিবাদ সভা নেই। নারীর সন্মান আজ ভূলুণ্ঠিত পিসির আদরের রত্ন জেহাদীদের হাতে।"
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
বুম তার হোয়াটসঅ্যাপ টিপলাইন নম্বরে (+ 917700906588) ভিডিওটি যাচাই করার অনুরোধ সহ একই ভিডিও পেয়েছে।
ওই ঘটনার অন্য এক ভিডিও হিন্দিতে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের উপর আক্রমণ দাবিতে ভাইরাল হয়।
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমে লক্ষ্য করে ভাইরাল ভিডিওগুলিতে পুলিশের গাড়িতে "বারাসত পুলিশ" লেখা রয়েছে। এই সূত্র ধরে, আমরা পুলিশের উপর হামলা সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজলে ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলার মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলির প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রতিবেদন পাই। প্রতিবেদনগুলি থেকে জানা যায় জনগণ সেই সময় ভিত্তিহীন শিশু অপহরণের গুজবের কারণে ওই মহিলাকে আক্রমণ করে।
নীচে কলকাতা টিভির ১৯ জুন, ২০২৪-এর একটি প্রতিবেদনে ভাইরাল ভিডিওর দৃশ্য দেখা যাবে।
বুম এর আগেও শিশু অপহরণের গুজবের কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নির্দোষ ব্যক্তিদের উপর জনতার আক্রমণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
এরপর, বারাসাতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলে তিনি নিশ্চিত করেন যে দুটি দাবিই ভুয়ো। ঝাড়খারিয়া বুমকে বলেন আক্রান্ত মহিলা মুসলমান সম্প্রদায়ের এবং এলাকায় ভিত্তিহীন শিশু অপহরণের গুজবের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা তার উপর হামলা করে। তিনি স্পষ্ট আমাদের জানান সাম্প্রদায়িক কোনও কারণে আক্রমণের এই ঘটনা ঘটেনি।
ঝারখারিয়া বলেন, "গত ১৯ জুন শিশু অপহরণ ও অঙ্গ পাচারের গুজবের উপর ভিত্তি করে বারাসাত থানার আওতাধীন এলাকায় জনতার হামলার দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনাটি সকাল ১০:৩০ টার দিকে মোল্লাপাড়া, অশ্বিনিপল্লী, ২৩ নং ওয়ার্ডে ঘটে, যেখানে নিজের নিত্যদিনের কাজ করার সময় এক ব্যক্তিকে শিশু অপহরণকারী সন্দেহে জনতা আক্রমণ করে। এর কিছু পরেই বারাসাতের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের সামনে আরও একটি ঘটনা ঘটে। স্কুলের ছুটির পরে বাচ্চাদের নিতে আসা অভিভাবকেরা এক মহিলা ও এক পুরুষকে শিশু অপহরণকারী বলে সন্দেহ করে এবং তাদের মারধর করতে শুরু করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিও এই দ্বিতীয় ঘটনার।"
বারাসাতের পুলিশ সুপার আরও বলেন, "ভিডিওতে মেহেরাবানু বিবি ওরফে নেহেরা বানু নামে এক নির্দোষ মহিলাকে জনতার হাতে আক্রান্ত ও পুলিশের তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।"
এই ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে ঝারখারিয়া দাবিটি নস্যাৎ করে বলেন, শিশু অপহরণের গুজবের কারণেই এই হামলা করা হয়।
পুলিশ সুপার আরও জানান, উক্ত ঘটনায় একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা এবং আক্রান্তের অভিযোগের উপর নির্ভর করে পুলিশ ইতিমধ্যেই ১০ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে।
ঝারখারিয়া বুমকে বলেন, "এই ঘটনার মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক দিক নেই। অনলাইনে প্রচারিত অপপ্রচার সম্পর্কে আমরা অবগত। এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন সুরজিৎ দে, বাবলু দাস, অমৃত মণ্ডল, দোলন দাস, অয়ন সাহা, শম্ভূ বনিক, রঞ্জিত পোদ্দার, প্রদীপ পোদ্দার, তাপস মালাকার এবং সুমিত সরকার।"