পশ্চিমবঙ্গের নবনির্বাচিত টিএমসি সাংসদ মহুয়া মৈত্র গত সপ্তাহে সংসদে তাঁর আগ্নেয় বক্তব্যে 'প্লেজিয়ারিজম' করেছেন বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন জি-নিউজ-এর সাংবাদিক সুধীর চৌধুরী। 'প্লেজিয়ারিজম' হল অপরের রচনা, উক্তি, চিন্তাভাবনা ইঃ নিজের বলে চালানো।
কিন্তু বুম তদন্ত করে দেখেছে, সেদিনের বক্তৃতায মহুয়া মৈত্র যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, সেগুলির উৎস হিসেবে তিনি মার্কিন হলোকাস্ট মেমোরিয়ালের একটি পোস্টারের প্রতি তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওই ধারণাগুলি টোকার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
যে নিবন্ধ থেকে মহুয়া টুকলি করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে, ওয়াশিংটন মান্থলির সেই নিবন্ধের লেখক মার্টিন লংম্যান নিজেই জানিয়েছেন, মহুয়া মোটেই তাঁর লেখা থেকে টোকেননি বা 'প্লেজিয়ারিজম' করেননি।
ভাইরাল হওয়া বক্তব্য
২৫ জুন ২০১৯ সংসদে তাঁর প্রথম বক্তব্যে মহুয়া ভারতে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক লক্ষণগুলির তালিকা দেন। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ৭ টি লক্ষণ তুলে ধরেন, যেগুলি তিনি মার্কিন হলোকাস্ট মেমোরিয়াল থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
গত সপ্তাহে তাঁর সেই বক্তৃতার ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় এবং প্রভূত জনসমর্থন আদায় করে নেয়।
অনুপ্রাণিত করার মতো তালিকা
প্রসঙ্গত মহুয়া মৈত্রই একমাত্র ব্যক্তি নন, য়িনি ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক লক্ষণগুলি বিষযে সতর্কতামূলক পোস্টারটি ব্যবহার করলেন।
৩১ জানুযারি ২০১৭ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা ওয়াশিংটন মান্থলির একটি নিবন্ধে লেখক মার্টিন লংম্যান ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে আমেরিকায় ফ্যাসিবাদের যেসব পূর্বলক্ষণ ফুটে উঠছে, সে বিষয়ে সতর্ক করেন। তা করতে গিয়ে তিনিও মার্কিন হোলোকাস্ট মেমোরিয়ালের প্রসঙ্গ টানেন।
বুম তথ্য-যাচাইকারী ওযেবসাইট স্নুপস-এর কাছ থেকে একটি রিপোর্টের খোঁজ পায়, যেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালের এপ্রিলে লরেন্স ব্রিট নামে এক অপেশাদার ঐতিহাসিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের শাসনকালে ওই তালিকাটি তৈরি করেছিলেন।
আমরা রেমন্ড ফ্ল্যান্ডেজ নামে মিউজিয়ামের এক জনসংযোগ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করি, যিনি জানান, তালিকাটি কখনও প্রদর্শনী হিসাবে ছিল না, তবে অল্প সময়ের জন্য মিউজিয়ামের গিফ্ট শপে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল।
তবে এটা একটা সাধারণ ভ্রান্তি যে তালিকাটি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং মহুয়া মৈত্র এবং লংম্যান উভয়েই তালিকাটি উদ্ধৃত করার সময় সেই ধারণারগুলিই ধার করেন।
প্রত্যেকে একই ভুল করছেন
মহুয়া মৈত্রের সংসদীয় ভাষণের এক সপ্তাহ পরে ডঃ বিজয চৌথাইওয়ালে—যিনি নিজেকে একজন বিজ্ঞানী এবং ভারতীয জনতা পার্টির বিদেশনীতি বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত বলে দাবি করেন—একটি টুইটে অভিযোগ করেন, মহুয়া ওয়াশিংটন মান্থলিতে প্রকাশিত লংম্যানের নিবন্ধ থেকে টুকেছেন।
জেএনইউ-র প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ইন্ডিযান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর অধিকর্তা মকরন্দ পরঞ্জপেও তাঁর টুইটার মারফত একই অভিযোগ আনেন।
এর একদিন পরে দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট স্বরাজ্য ম্যাগ অভিযোগ করে, মহুয়া মৈত্র তাঁর সংসদের বক্তৃতায অন্য লেখা থেকে টোকার দায়ে পড়েছেন এবং টুকলির মূল উৎস হিসেবে সেই মার্কিন হোলোকাস্ট মেমোরিয়ালের পোস্টারটির দিকেই নির্দেশ করে।
সুধীর চৌধুরীর প্রবেশ
জি-নিউজের সাংবাদিক সুধীর চৌধুরী ওই চ্যানেলে বিষয়টি টেনে আনেন এবং মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে প্রকাশিত ওয়াশিংটন মান্থলিতে প্রকাশিত লংম্যানের নিবন্ধ থেকে টুকলি করার অভিযোগ পুনরাবৃত্তি করেন।
চৌধুরী দাবি করেন, মহুযার বক্তৃতায় উল্লেখিত ‘ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণ’-এর তালিকা পুরোপুরি লংম্যানের নিবন্ধ থেকে টোকা, তাই তাঁকে টুকলির দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত। তাঁর দাবি, “এই যে ভাষণটি সারা দেশে প্রশংসিত হচ্ছে, তার ধারণাগুলি সবই অন্য লোকের থেকে চুরি করা। মহুয়া যে সব বিষয় উত্থাপন করেছেন, সেগুলি সবই একটি মার্কিন ওয়েবসাইটে ইতিপূর্বেই প্রকাশিত।”
স্রেফ চৌধুরীর প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে লেখা একটি রিপোর্টে ডিএনএ সংবাদপত্রেও একই ভাবে মহুয়া মৈত্রের জ্বালাময়ী ভাষণকে তথ্যের উত্স। উল্লেখ না করার দোষে দোষী সাব্যস্ত করে লেখা হয়—“2017 সালের 31 জানুযারি দ্য ওয়াশিংটন মান্থলিতে প্রকাশিত নিবন্ধ ‘ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক পূর্বলক্ষণ’ থেকে সরাসরি ঝেড়ে মহুযার বক্তৃতাটি তৈরি হয়েছে।”
চৌধুরীর প্রতিবেদন কিংবা ডিএনএ-র রিপোর্ট, কোথাও কিন্তু জানানো হযনি য়ে, মহুযা মৈত্র তাঁর বক্তৃতায ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণ সংক্রান্ত ধারণাগুলির উত্সের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন।
বুম এ ব্যাপারে চৌধুরীর ব্যাখ্যা চেযেছিল, কিন্তু তিনি কোনও জবাব দেননি। তাঁর জবাব পাওয়া গেলে নিশ্চয় এই প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হবে।
চৌধুরী এবং জি-নিউজ-এর অভিযোগ, মহুযা তাঁর বক্তৃতায় ওয়াশিংটন মান্থলির নিবন্ধটি কার্যত “কপি-পেস্ট” করেছেন। বুম 2017 সালে প্রকাশিত ওই নিবন্ধের সঙ্গে মহুয়া মৈত্রের ভাষণের বয়ানটি মিলিয়ে দেখেছে—দুটির মধ্যে একমাত্র সাদৃশ্য হল ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণ সংক্রান্ত তালিকাটি, যেটি আবার লরেন্স ব্রিট নামক এক ঐতিহাসিকের রচিত।
'প্লেজিয়ারিজম' কী?
অক্সফোর্ড লেক্সিকো অনুযায়ী প্লেজিয়ারিজম তাকেই বলা হবে, যেখানে অন্যের কোনও বক্তব্য বা ধারণাকে স্বীকৃতি না দিয়ে কেউ নিজের বলে চালিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, মহুয়া তাঁর বক্তব্যে ফ্যাসিবাদের যে ৭ টি পবর্বলক্ষণ সম্পর্কিত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সেগুলি পুরনো একটি তালিকা থেকে নেওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি কি তাঁর বক্তৃতায় এগুলিকে তাঁর নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন?
তাঁর ১০ মিনিটের ভাষণে পরিষ্কারভাবে মহুয়া জানাচ্ছেন, কোথা থেকে তিনি এই পূর্বলক্ষণের তালিকাটি পেয়েছেন।
অক্সফোর্ড লেক্সিকো অনুযায়ী প্লেজিয়ারিজম তাকেই বলতে হবে, যাতে অন্যের কোনও বক্তব্য বা ধারণাকে স্বীকৃতি না দিয়ে কেউ নিজের বলে চালিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, মহুয়া তাঁর বক্তব্যে ফ্যাসিবাদের যে ৭ টি পর্বলক্ষণ সম্পর্কিত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সেগুলি পুরনো একটি তালিকা থেকে নেওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি কি তাঁর বক্তব্যে এগুলিকে তাঁর নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন?
তাঁর 10 মিনিটের ভাষণে পরিষ্কারভাবে মহুয়া জানাচ্ছেন, কোথা থেকে তিনি এই পূর্বলক্ষণের তালিকাটি পেয়েছেন।
তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন—“২০১৭ সালে মার্কিন হলোকাস্ট মেমোরিয়ালের প্রধান লবিতে ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণ বিষয়ে এই তালিকাটির পোস্টার প্রদর্শিত হযেছিল এবং যে ৭ টি পূর্বলক্ষণের কথা আমি আপনাদের বলছি, তার সবকটিই সেই পোস্টারে রয়েছে ”
নীচের ভিডিওটিতে আমরা মহুযার বক্তব্যের সেই অংশটুকুই দিয়েছি, যেখানে মহুয়া তাঁর ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণের তালিকার উৎস বিষয়ে কথা বলছেন:
এ থেকেই প্রমাণ হয়ে হয় যে, মহুয়া মৈত্র অন্যের কোনও ধারণাকে নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করেননি।
বুম এ ব্যাপারে মহুয়ার বক্তব্যও জানতে চায়, তবে তিনি এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তাঁর বক্তব্য পেলে তদনুযায়ী আমরা প্রতিবেদনটি সংস্করণ করব।
তবে সংসদ ভবনের বাইরে তিনি মার্টিন লংম্যানের সেই টুইটের কথা সাংবাদিকদের জানান, যেখানে লংম্যান বলিছেন যে মহুয়া আদৌ তাঁর লেখা থেকে টোকেননি।
নোটঃ এই প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হয়েছে মার্কিন হোলোকাস্ট মেমোরিয়ালের এক প্রতিনিধি বুমকে একথা জানানোর পর যে, মিউজিয়ামে ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণের তালিকাটি কখনও প্রদর্শনীর জন্য রাখা ছিল না, তবে তার গিফ্ট শপে কিছু কালের জন্য রাখা ছিল।