২০১৯ সালের একটি ভিডিওতে মহাশয় ধর্মপাল গুলাটিকে একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর শুভাকাঙ্খীরা। তাঁদের মধ্যে একজন একটি জাতীয়তাবোধক গান গেয়ে শোনাচ্ছেন তাঁকে। ভিডিওটিকে তাঁর জীবনের অন্তিম সময় বলে চালানো হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার গুলাটির জীবনাবসান হয়।
গুলাটি ছিলেন বিখ্যাত মশলা প্রস্তুতকারক কম্পানি এমডিএইচ-এর সিইও বা প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসার। ৩ ডিসেম্বর ২০২০ তে উনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।
২৭ মার্চ ১৯২৩ শিয়ালকোটে (এখন পাকিস্তানে) তাঁর জন্ম হয়। জীবনে খুব কঠিন পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে উনি এমডিএইচ প্রতিষ্ঠা করেন। ওঁর বাবা শিয়ালকোটে একটি ছোট মশলার দোকান খোলেন, যেটি 'দেগ্গি মশালা ওয়ালে' নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর, গুলাটি তাঁর পরিবার সমতে দিল্লি চলে আসেন। এমডিএইচ মশলার টিভি বিজ্ঞাপনে তাঁকে দেখা যেত বলে, ভারতীয়দের কাছে গুলাটির মুখটা পরিচিত হয়ে ওঠে। ওই 'মশলা রাজা'র ধূমকেতুর মতো উত্থানের বৃত্তান্ত পড়ুন এখানে।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে জীর্ণ শরীর নিয়ে একটি হাসপাতালের খাটে শুয়ে আছেন গুলাটি আর তাঁকে ঘিরে রয়েছেন কয়েকজন ব্যক্তি। লাল শার্ট পরা একজন তাঁকে 'পুরব অওর পশ্চিম' সিনেমার একটি দেশাত্ববোধক গান গেয়ে শোনাচ্ছেন। এবং দেখে মনে হচ্ছে, উনি গানটি উপভোগ করছেন।
৩ ডিসেম্বর ২০২০ তে গুলাটির মৃত্যুর পর, ওই ভিডিওটি এক বিভ্রান্তিকর দাবি সমেত শেয়ার করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ক্লিপটি এই দাবি সমেত শেয়ার করা হয়েছে যে, ভিডিওটিতে ওই ব্যবসায়ীর জীবনের শেষ মুহূর্তটি দেখানো হয়েছে।
সাংবাদিক বিকাশ ভাদোরিয়া ক্লিপটি টুইট করেন ও সঙ্গে ক্যাপশনে লেখেন, "মশালা কিং মহাশয় ধর্মপালের (এমডিএইচ) শেষ মুহূর্ত। জীবনের অন্তিম সময়েও দেশের জন্য তাঁর হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছিল।"
(হিন্দিতে লেখা ক্যাপশন: मसाला किंग महाशय धर्मपाल (MDH) की आख़िरी समय की तस्वीरें, आख़िरी समय में भी उनका दिल देश के लिए ही धड़कता रहा)
চিত্র পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীও ওই একই ভিডিও একই দাবি সমেত শেয়ার করেন।
বিগত কয়েক ঘন্টায়, ভিডিওটি একাধিক টুইটার হ্যান্ডেল ও ফেসবুক পেজ থেকে শেয়ার করা হয়।
ভিডিওটি ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। ক্যাপশনে বলা হয়েছে, "মশালা কিং মহাশয় ধর্মপালের (এমডিএইচ) শেষ মুহূর্ত। জীবনের অন্তিম সময়েও দেশের জন্য তাঁর হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছিল।"
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
তথ্য যাচাই
ভিডিওটির প্রধান ফ্রেমগুলি দিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলেও, কোনও ফলাফল পাওয়া যায়নি।
এর পর বুম গুলাটির মৃত্যু সংক্রান্ত প্রতিবেদনের খোঁজ করলে দেখা যায়, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দিল্লির মাতা চমন দেবি হাসপাতালে মারা যান।
আমরা ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিডিওটি সম্পর্কে জানতে চাইলে, তাঁরা বলেন, সেটি পুরনো।
"ঠিক কবে সেটি তোলা হয়, তা আমি মনে করতে পারছি না। কিন্তু ওটি পুরনো। আমি ওই ভিডিওতে একজনকে চিনতে পারছি। কিন্তু তিনি এখন আর এই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত নন," বলেন এক আধিকারিক।
এর পর আমরা টুইট-করা পোস্টগুলিতে যে সব মন্তব্য এসেছে সেগুলি খুঁটিয়ে দেখি। দেখা যায়, ভিডিওটিতে যে ব্যক্তি গান গেয়েছিলেন, তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে একটি মন্তব্যে।
টুইটার ব্যবহারকারী গায়কের নাম রাকেশ আহুজা হিসেবে উল্লেখ করলেও, তিনি ভিডিওটির টাইমলাইন সম্পর্কে কিছু লেখেননি। আমরা ফেসবুকে রাকেশ আহুজার খোঁজ করি। কিন্তু তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল লক করা ছিল। এর পর আমরা গগন আহুজা নামের এক ব্যক্তির খোঁজ করি ফেসবুকে। সেখান থেকে আমরা তাঁর টেলিফোন নম্বর পেয়ে যাই।
আমরা ফেসবুকে গগন আহুজার খোঁজ করি কারণ, গগন আহুজা তাঁর প্রোফাইল থেকে ওই একই ভিডিও শেয়ার করে ছিলেন। তিনি ভিডিওটি হিন্দি ক্যাপশনে যা লেখেন, তা এই রকম: "সঙ্গীতের এক আশ্চর্য শক্তি আছে...প্রায় এক বছর ধরে অসুস্থ, হাসপাতালে মহাশয়জির হাত, পা নাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার পারিবারিক বন্ধু রাকেশ আহুজা এমডিএইচ কিং মহাশয়জিকে হাসপাতালে দেখতে যান। উনি মহাশয়জির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী, উনি মহাশয়জির খুব প্রিয় একটা গান গেয়ে শোনান। প্রায় দু'মাস, তিনি তাঁর হাত-পা নাড়াতে পারছিলেন না। কিন্তু সঙ্গীতের যাদু নিজের চোখেই দেখুন।"
আমরা গগন আহুজাকে ফোন করি। উনি আমদের নিশ্চিত করেন যে, গানটির গায়ক হলেন রাকেশ আহুজা। এবং ভিডিওটি পুরনো।
এর পর রাকেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে উনি বলেন, ভিডিওটি ২০১৯ সালে তোলা হয়।
"২০১৯-এর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে মহাশয়জি দিল্লির একটি হাসপাতালে ভর্তি হলে, আমি তাঁকে দেখতে যাই। মহাশয়জি শরীর নাড়চাড়া করতে পারছিলেন না। ডাক্তাররা আমায় মহাশয়জির জন্য বেশ উদ্দীপক কোনও একটা গান গাইতে বলেন। আমি গান গাই। এবং উনি আমায় আশির্বাদ করেন," রাকেশ বুমকে বলেন।
উনি আরও বলেন যে, ভিডিওটি উনি নিজের জন্যই তৈরি করেছিলেন। তাই সেটি উনি তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেননি। "কিন্তু গতকাল তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর, আমি ভিডিওটি ফেসবুকে শেয়ার করি। কিন্তু ওই পোস্টটিতে আমি কিছু বলিনি," আহুজা বলেন বুমকে।
রাকেশ জানান যে, ভিডিওটি মাতা চমন দেবি হাসপাতালে তোলা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: সোশাল মিডিয়ায় ছড়াল হাসপাতালে ভর্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যু গুজব