তেলেঙ্গানায় ২৬ বছর বয়স্কা ধর্ষিতা মহিলা পশু-চিকিৎসকের আগুনে পোড়া দেহ খুঁজে পাওয়ার পর দিনই দক্ষিণপন্থী টুইটার ব্যবহারকারীরা ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ার অপচেষ্টা করে দাবি করেছে, মুসলিমরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বুম এ নিয়ে তদন্তকারী সাইবারাবাদ পুলিশের সঙ্গে কথা বললে তারা শুধু এই দাবি অস্বীকারই করার পাশাপাশি, এই বিষয়ে কোনও ভুয়ো খবর এবং স্পর্শকাতর সাম্প্রদায়িক পোস্ট প্রচারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলাতেই একটি সাংবাদিক বৈঠক করে তারা অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করে দিয়েছেন, যারা হলো—মহম্মদ ওরফে আরিফ, জল্লু শিবা, জল্লু নবীন এবং চিন্তাকুন্তা চেন্নাকেশবুলু।
তদন্তকারী দলের এক পদস্থ অফিসার বললেন, "অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন হিন্দু এবং একজন মুসলিম। তাহলে এই অপকর্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোথয় বলুন?"
"বরং এই সব অপপ্রচারে বাবা-মায়েদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।"
বৃহস্পতিবার ভোরে হায়দরাবাদ শহরের উপকণ্ঠে চতনপল্লী গ্রামে আউটার রিং রোডের একটি আন্ডারপাসের নীচে মহিলার দগ্ধ দেহটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। বৃহস্পতিবারেই সাইবারাবাদ পুলিশ অভিযুক্ত চারজন নবীন, শিবা, কেশবুলু ও মহম্মদকে গ্রেফতার করে।
দ্য নিউজ মিনিট (টিএনএম) রিপোর্ট করে, মহিলা চিকিত্সক ছিলেন শামসাবাদের বাসিন্দা এবং কাজে যেতেন নবাবপেট-এ। ২৭ নভেম্বর তিনি গাছিবৌলি থেকে ফিরছিলেন। এবং তন্ডুপল্লি টোল প্লাজার কাছে পার্ক করে রাখা নিজের দু-চাকাটি যখন তিনি আনতে যান, তখন এক লরি-চালক তাঁকে জানায় যে দু-চাকাটির পিছনের চাকা ফুঁটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে লরি-চালকটি তাকে সাহায্য করার প্রস্তাবও দেয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এর পরেই মহিলা চিকিত্সক বাড়িতে তার বোনকে ফোন করেন, যাতে তাকে বেশ উদ্বিগ্ন ও ভীত মনে হয়, আর তার পরে তার আর কোনও খবর মেলে না। ফোনের ট্রান্সস্ক্রিপটও রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।
অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার খবর পুলিশ প্রকাশ করার আগে থেকেই বেশ কয়েকটি টুইটার হ্যান্ডেল—বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী লোকেদের হ্যান্ডেল—থেকে ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে টুইট করা শুরু হয়ে যায়।
চলচ্চিত্র নায়িকা পায়েল রোহাতগি তার টুইটে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লেখেন, "হায়দরাবাদের শাদনগরে এক হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ করে ধর্ষকরা হত্যা করেছে। শাদনগর কি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এলাকা?"
ভুয়ো খবরের ওয়েবসাইট পোস্টকার্ড নিউজ-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং অতীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ভুয়ো খবর প্রচারের জন্য গ্রেফতার হওয়া মহেশ হেগড়ে টুইট করেন, "হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় ভগিনী ডাক্তার (ধর্ষিতার নাম) ধর্ষিত এবং জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। আর কেউ নয়, মহম্মদ পাশা ও তার দলের লোকেরাই এই অপকর্ম করেছে।"
অতীতেও সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানো ভুয়ো খবর প্রচারে সিদ্ধহস্ত আইনজীবী প্রশান্ত উমরাও প্যাটেল তার টুইটে লেখেন, "মহম্মদ পাশা ও তার দলবল হায়দরাবাদের মহিলা ডাক্তারকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। ওরা সমগ্র মানবতার পক্ষেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এবং সব হিন্দু মহিলাদেরই ওরা শিকার বানাতে চায়।"
বৃহস্পতিবার বিকেল নাগাদ সাইবারাবাদ পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতারের খবর ঘোষণা করার আগেই টুইটারে ''#বলাৎকারী মহম্মদ নিকালা'' এবং ''#মহম্মদ পাশার ফাঁসি চাই'' জাতীয় হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ভারতীয় জনতা পার্টির তথ্য-প্রযুক্তি শাখার ভারপ্রাপ্ত অমিত মালব্যও ঘটনাটির বিবরণ টুইট করেন, কিন্তু তিনি তাতে কেবল একজন অভিযুক্ত মহম্মদের নাম উল্লেখ করেন, বাকিদের কথা চেপে যান।
বিজেপি বিধায়ক রাজা সিং ঘটনাটি নিয়ে একটি ভিডিও টুইট করেন, যেখানে তিনি ধারণা করেন, জনৈক মহম্মদ বা তার মতো কোনও মুসলিমই নিশ্চয়-এ ধরনের ঘটনায় জড়িত হবে।
দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট স্বরাজ্য ঘটনাটি রিপোর্ট করেছে, কিন্তু সেখানে অন্য অভিযুক্তদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কেবল মহম্মদের নাম জানানো হয়েছে। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, "প্রধান অভিযুক্তকে মহম্মদ পাশা বলে শনাক্ত করা হয়েছে, যে তার দলবলকে নিয়ে মহিলাকে অপহরণ করে, গণধর্ষণ করে এবং হত্যা করে। এই পাশা মেহবুবনগর জেলার বাসিন্দা।"
নিয়মিত ভুয়ো খবর এবং স্পর্শকাতর সাম্প্রদায়িক মিথ্যা শেয়ার করতে অভ্যস্ত মধুপূর্ণিমা কিশোয়ারও স্বরাজ্য-র প্রতিবেদনটি শেয়ার করেছেন এবং লিখেছেন, "অথচ ওরা আমাদের বলে, আমাদের ইসলাম-আতঙ্ক ছড়ানো উচিত নয়। সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এই যদি তাদের ক্রিয়াকলাপ হয়, তাহলে একদিন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হলে আমাদের ভাগ্যে কী আছে একবার কল্পনা করুন!"
সুদর্শন নিউজ-এর সম্পাদক সুরেশ চাভাঙ্কে—যিনি নিয়মিত ভুয়ো খবর শেয়ার করেন এবং উস্কানিমূলক বিবৃতি প্রচার করেন—লিখেছেন, "পুলিশ জোর করে দুজন হিন্দুকে গ্রেফতার করেছে, যাতে মহম্মদের গ্রেফতারিতে ভাসরাম্য আনা যায়। " বুম অতীতে একাধিক বার সুরেশ চাভাংকের ভুয়ো, উস্কানিমূলক প্রতিবেদনের পর্দাফাঁস করেছে।
তথ্য যাচাই
সাইবারাবাদ পুলিশ প্রেস বিবৃতি মারফত জানিয়েছে, তারা চারজনকে গ্রেফতার করেছে, দুজন লরি-চালক এবং বাকি দুজন তাদের খালাসি। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে মহম্মদ ওরফে আরিফ, শিবা, নবীন এবং কেশবুলু ওরফে চেন্না হিসাবে, যারা সকলেই তেলেঙ্গানার নারায়ণপেট জেলার বাসিন্দা।
পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, "এরা সকলেই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এমনকী পাশাপাশি রাজ্যেও মাল পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। ২৬ নভেম্বর তারা তোন্ডুপল্লি টোল প্লাজার কাছে তাদের লরি পার্ক করে, যেহেতু মালের ডেলিভারি যে নেবে, সে তখনও আসেনি। ২৭ নভেম্বর সন্ধেবেলায় যখন তারা এক মহিলাকে তার স্কুটার তাদের লরিরই কাছাকাছি পার্ক করতে দেখে, তখনই তারা কুকর্মের মতলবটি ভেঁজে নেয়। সে সময় তারা মদ্যপ অবস্থাতেও ছিল।
"পরিকল্পনা অনুযায়ী নবীন মহিলার স্কুটারের পিছনের চাকা ফুঁটো করে দেয় এবং সন্ধ্যার সময় যখন মহিলা তার স্কুটারটি নিতে আসেন, তখন মহম্মদ তার লরি থেকে নেমে এসে মহিলাকে জানায় যে, তার স্কুটারের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। সে আগ বাড়িয়েই মহিলাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয় এবং তার খালাসি শিবাকে চাকার পাংচার সারিয়ে দিতে বলে। অপেক্ষা করার সময়েই মহিলা তার বোনকে ফোন করে জানান, তার কেমন ভয়-ভয় করছে এবং তিনি লোকগুলির চেহারা ও চলনের বর্ণনাও দেন। কিছুক্ষণ পরে খালাসি শিবা ফিরে এসে বলে, চাকা সারানোর দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এবং অন্য কোনও দোকানে তা সারাবার জন্য নিয়ে যায়। এই সময়েই মহম্মদ, নবীন ও কেশবুলু জোর করে মহিলাকে তুলে নিয়ে কাছের একটি চত্বরে যায়। ইতিমধ্যে শিবাও ফিরে আসে এবং তারা পালা করে মহিলাকে ধর্ষণ করে।
"ধর্ষণ পর্ব শেষ হওয়ার পরেই মহম্মদ মহিলার নাক-মুখ গায়ের জোরে চেপে ধরে এবং তিনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। এরপর মহম্মদ ও কেশবুলু মহিলার দেহটি লরির কেবিনে তুলে বাঁ দিকে চলে যায় আর শিবা ও নবীন তার স্কুটারটি নিয়ে এক বোতল পেট্রল কিনতে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাদনগর মোড়ের কাছের আন্ডারপাসে ওরা চারজনেই পৌঁছে যায়। সেখানে কম্বল চাপা দিয়ে নিহত মহিলার দেহটি নিয়ে গিয়ে তাতে পেট্রল ও ডিজেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।" সাইবারাবাদ পুলিশের কমিশনার সি ভি সাজ্জানার এ ভাবেই ঘটনাটি বিবৃত করেন।
বুমের এক প্রশ্নের জবাবে সাজ্জানার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, ''না, এই ঘটনার মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক মতলব বা বিদ্বেষ নেই।