লেখক, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদ মধু কিশওয়ার আবার বিতর্কের মুখে পড়েছেন। একটি ভুয়ো খবরে দাবি করা হয় সাংবাদিক রাণা আয়ুব শিশু ধর্ষণ সমর্থন করেছেন। দাবির সমর্থনে আয়ুবের একটি তথাকথিত মন্তব্যও প্রকাশ করা হয় ওই খবরে। বিষয়টির সত্যতা যাচাই না করেই কিশওয়ার সেটি টুইট করে বসেন।
কিশওয়ার টুইট করা মাত্রই টুইটারে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ কিশওয়ার টুইটটি তুলে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও আয়ুব তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন।
আয়ুব সম্পর্কে টুইট করার একদিন আগে কিশওয়ার বালাজি তিরুপতি মন্দিরের সদ্য নিযুক্ত সভাপতি ওয়াইভি সুব্বা রেড্ডি সম্পর্কেও একটি ভুল তথ্য পোস্ট করেন। তাতে বলা হয় সুব্বা রেড্ডি একজন খ্রিস্টান, যিনি “অন্ধ্রে আরও অনেক চার্চ স্থাপনের জন্য কাজ করে চলেছেন।”
এমনটা যে এই প্রথম ঘটল তা কিন্তু নয়। আগেও অনেকবার কিশওয়ারের করা পোস্টের বিষয়বস্তু হয় বিভ্রান্তিকর, নয় সরাসরি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বুম তাঁর পোস্টগুলির তথ্য যাচাই করে এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করে, কেন উনি টুইটারে ওই ধরনের পোস্ট করে থাকেন।
একটি পুরনো ফোটোশপকরা ছবির পুনর্ব্যবহার
১২ জুন ২০১৯ কিশওয়ার একটি ফটো টুইট করেন, যেখানে রিপাবলিক টিভিকে দেওয়া রাণা আইয়ুবের একটি মিথ্যে উদ্ধৃতি দেওয়া ছিল; যেখানে তিনি শিশু ধর্যকদের মানব অধিকারের পক্ষে কথা বলেন।
কিশওয়ারের প্রায় ২০ লক্ষ ফলোয়ার আছে। তার মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। ফলে, তাঁর টুইট মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় আর হাজারেরও বেশি লাইক পায় এক ঘন্টার মধ্যে।
যে ভুয়ো উদ্ধৃতিটি উনি টুইট করেন, সেটি অন্য একটি ফোটোশপ-করা টুইটের স্ক্রিনশট থেকে নেওয়া। প্রথম টুইটটি করেছিল @রিপাবলিকটিভি নামের একটি প্যারডি হ্যান্ডল। ওই স্ক্রিনশটটি কয়েকবারই ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে ভুয়ো বলে চিহ্নিত করেছিল ‘অল্ট নিউজ’।
আয়ুবের প্রতিক্রিয়া, কিশওয়ারের “মিথ্যে খবরের কারখানা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য” তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবেন ঠিক করেছেন। আয়ুব সম্পর্কে মিথ্যে খবর ছড়ানোর ফলে, তাঁকে নানান রকম হুমকি দেওয়া হয়েছে, এমনকি ধর্ষণের হুমকিও। তেমনটাই দাবি করেছেন আয়ুব।
কিশওয়ার তৎক্ষনাৎ টুইটটি ডিলিট করে দেন। সেই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, “ব্রেকআপইন্ডিয়াব্রিগেড-এর বিরুদ্ধে উনি আর ভুয়ো খবর ব্যবহার করবেন না।”
বুম কিশওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানতে চাওয়া হয়, কেন উনি ওই ভুয়ো স্ক্রিনশট পোস্ট করেছিলেন? উনি বলেন, সেটি যে ভুয়ো সে কথা উনি জানতেন না। তাঁর এক “অতি বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু” তাঁকে সে কথা জানায়।
কিশওয়ার বুমকে বলেন, “আমার বন্ধুর কথা অনুযায়ী আমি কাজ করি। কারণ উনি খুবই বিশ্বাসযোগ্য।তবে আমি টুইটটা ডিলিট করে দিই এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করি।
তবে আয়ুব মনে করেন, কিশওয়ার ইচ্ছে করেই তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো খবর ছড়ান।
“অতীতেও, জেনেশুনে মধু কিশওয়ার মিথ্যে খবর পোস্ট করেছেন। এটা এক ধরনের বজ্জাতি এবং ইচ্ছে করেই করা,” আয়ুব বুমকে বলেন।
রাণা আরও বলেন, ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি অশোক পন্ডিতও ওই একই ছবি টুইট করেন। সেই কারণে, ওনার বিরুদ্ধেও মামলা করা যেতে পারে।
“ওই ভুয়ো টুইট সম্পর্কে আমি ইতিমধ্যেই দিল্লি পুলিশের কাছে কেস নথিভুক্ত করেছি। এবার কিশওয়ার আর পন্ডিতের করা টুইটগুলিও ই-মেল করব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে, যাতে তাঁদেরও এই মামলায় জুড়ে দেওয়া যায়,” বলেন আয়ুব। “ওঁনার টুইটের ফলে, আমায় ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়। যদি দিল্লি পুলিশ কোনও পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আমি কোর্টে যাব।”
এই ব্যাপারে কিশওয়ার বলেন, “উনি স্বচ্ছন্দে তা করতে পারেন”। বুমকে কিশওয়ার বলেন, দুঃখ প্রকাশ করার মধ্যে দিয়ে উনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, পাবলিক ডোমেইনে বা জনসমক্ষে যা কিছু রেখেছেন তার পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন উনি।
বুমকে উনি আরও বলেন, “আয়ুব নিজেই বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু পাবলিক ডোমেইনে রেখেছেন।” কিশওয়ার ইঙ্গিত করছিলেন আয়ুবের বই ‘গুজরাট ফাইল’ ও ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাণাঘাটে এক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণের ঘটনার ওপর লেখা আয়ুবের মতামত।
“যে ভুল তথ্য আয়ুব প্রকাশ করেছেন, তার জন্য কি উনি ক্ষমা চাইবেন?” জানতে চান কিশওয়ার।
দিল্লি পুলিশ কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত বা কিশওয়ারের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস না করা অবধি কিশওয়ার আর আয়ুবের ঝগড়া আপাতত স্থগিত আছে। তবে ভুয়ো টুইট সংক্রান্ত কিশওয়ারের ব্যক্তিগত রেকর্ড মোটেই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
আরও একটি ভুল
কিশওয়ার আর আয়ুবের বিবাদ সামনে আসার আগের দিন, কিশওয়ার একটি টুইটে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির মামা ওয়াইভি সুব্বা রেড্ডি সম্পর্কেও মন্তব্য করেন। ওয়াইভি সুব্বা রেড্ডি সম্প্রতি তিরুপতি তিরুমালা বালাজি মন্দিরের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে কিশওয়ার বলেন উনি একজন গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক, যাঁর আসল নাম ‘যিহোভা ভিনসেন্ট’।
টুইটে আরও দাবি করা হয় যে, রেড্ডি “অন্ধ্রপ্রদেশে আরও চার্চ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেন।”
কিশওয়ারের ওই দাবি টুইটারে ভাইরাল হয়ে যায়। ব্যাপারটা এমনই দাঁড়ায় যে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মনিয়াম স্বামীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিশওয়ারের কথা নসাৎ করে স্বামী বলেন, “সুব্বা রেড্ডি একজন পাক্কা হিন্দু।”
ফলে, রেড্ডি সম্পর্কে কিশওয়ারের দবি হাস্যকর প্রমাণিত হয়। নির্বাচনে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উনি যে হলফনামা জমা দিয়ে ছিলেন তা থেকে জানা যায় তাঁর নাম আসলে ‘ইয়ার্রাম ভেঙ্কাটা’।
বুম রেড্ডির সঙ্গে যোগাযোগ করে। সুব্রহ্মনিয়াম স্বামীর বক্তব্য যে, উনি নানা রীতিনীতি মেনে-চলা একজন হিন্দু, উনি সে কথা সমর্থনও করেন।
“আমার গোটা পরিবারই হিন্দু—বাবা, মা, স্ত্রী, সকলেই। আমরা সব হিন্দু রীতিনীতি মেনে চলি। ওই সব ব্যক্তি অযথা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য গুজব ছড়াচ্ছেন,” বলেন রেড্ডি।
কিশওয়ারকে প্রশ্ন করা হয়, কেন উনি ওই টুইট করেন। উত্তরে উনি বলেন, “এটা জানা কথা যে, ওয়াইএসআর ব্যাপক ধর্মান্তরকরণের কাজ করেছেন।”
সুব্বা রেড্ডির ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় কারণ, জগন মোহন রেড্ডি নিজে একজন খ্রিস্টান। তার ফলে, অনেকের মনে হয়, জগন মোহনের মামা সুব্বা রেড্ডিও খ্রিস্টান।
জগন মোহন রেড্ডির বাবা ওয়াইএস রাজাশেখর রেড্ডি এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ওয়াইএস বিজয়লক্ষ্মীর জন্ম কিন্তু হিন্দু হিসেবেই। পরে, বিয়ের সময়, উনি খ্রিস্টান হন।
তবে বিজয়লক্ষ্মীর দিকের পরিবারের সকলেই ধর্মপ্রাণ হিন্দু। ওয়াইভি সুব্বা রেড্ডিও তাঁদের মধ্যে একজন।
ক্রমিক অপরাধী নাকি শিকার?
দেখা গেছে, অতীতে মধু কিশওয়ার এমন সব টুইট করেছেন যার বিষয়বস্তু একেবারে ভুয়ো।
উনি একবার দাবি করেন যে, কাশ্মীরি জঙ্গি বুরহান ওয়ানিকে যে পুলিশ অফিসার মেরে ছিলেন, তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। তাঁকে সাসপেন্ড করেন জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল। কারণ, “বুরহানের মৃত্যুতে মেহবুবা মুফতি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।”
কিশওয়ারের টুইটের জবাবে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ জানায় কোনও পুলিশ অফিসারকেই সাসপেন্ড করা হয়নি।
কিশওয়ার আরও দাবি করেছিলেন যে, সঞ্জয় লীলা বানসালির ফিল্ম ‘পদ্মাবত’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালে গুরুগ্রামে একটি স্কুল বাসের ওপর যারা হামলা করেছিল তারা মুসলমান। তাদের নামও কিশওয়ার দিয়ে দিয়েছিলেন — “সাদ্দাম, আমির, ফিরোজ, নাদিম ও আশ্রাফ”।
আবারও তাঁর দাবি খন্ডিত হয়। গুরুগ্রাম পুলিশ জানায় যে, গুরুগ্রামে একটি হরিয়ানা রোডওয়েজের বাস ও একটি স্কুলবাসের ওপর হামলার ঘটনায় “কোনও মুসলমান যুবককে আটক করা হয়নি।”
কিশওয়ারের সঙ্গে কথা বলার সময় বুম জানতে চায়, কেন উনি ওই ধরনের ভুল খবর বারবার সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন? উত্তরে কিশওয়ার বলেন, সেগুলি যে ভুল খবর, সে কথা তিনি জানতেনই না।
“কোনও এক আইএএস অফিসার যদি আপনাকে কোনও খবর দেন, আপনি কি তা অবিশ্বাস করবেন? ওই ঘটনাটির সময়, চন্ডীগড়ের এক উচ্চপদস্থ আইএএস অফিসার বাসের ওপর হামালার একটি রিপোর্ট আমায় পাঠান। তো আপনি কি সেটা বিশ্বাস করবেন না?” বলেন কিশওয়ার।
সুব্বা রেড্ডির ক্ষেত্রে কিশওয়ার বলেন উনি একজন অভিজ্ঞ টিভি সাংবাদিকের কাছ থেকে ওই তথ্য পেয়েছিলেন। এবং বিশ্বাস করার জন্য সেটাই তো যথেষ্ট ছিল।
বুম জানতে চায় যে, খবরগুলি পোস্ট করার আগে সেগুলি উনি কেন যাচাই করে নেননি। বিশেষ করে যখন কিশওয়ার নিজেকে `ফ্যাক্টারিয়াল’ বা তথ্য-নির্ভরশীল বলে বর্ণনা করেছেন নিজের টুইটার পরিচিতিতে। উত্তরে উনি বলেন, “একটি প্রথমসারির টিভি চ্যানেলের সিনিয়র সাংবাদিকের ওপর যদি নির্ভর করা না যায়, তাহলে আস্থা রাখব কার ওপর? আমরা তো কেউ সারাদিন তথ্য-যাচাই করার কাজে ব্যস্ত থাকতে পারি না।”
অতিরিক্ত রিপোর্টিং নিবেদিতা নিরঞ্জনকুমার।