ভারতীয় জনতা পার্টিতে বাংলাদেশের অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষের অন্তর্ভুক্তি এবং তার পর তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের তরফে বিভিন্ন নথি দাখিল করায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।
অঞ্জু দলে যোগ দেওয়ার পরেই যারা তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল, দিলীপবাবু তাদের উদ্দ্যেশ্যে অঞ্জুর জন্ম-সার্টিফিকেট শেয়ার করেন।
ওই সার্টিফিকেট বা শংসাপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, এই প্রাক্তন বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ১৯৬৬ সালে কলকাতার ইস্ট এন্ড নার্সিং হোম প্রাইভেট লিমিটেডে সুধন্য এবং বীণাপাণি ঘোষের কন্যা হিসাবে ভূমিষ্ঠ হন।
কিন্তু অঞ্জু ঘোষ ইতিপূর্বে যে-সব সাক্ষাত্কার দিয়েছেন কিংবা অনলাইনে তাঁর সম্পর্কে যে-সব তথ্য রয়েছে, শংসাপত্রে উল্লেখিত তথ্যের সঙ্গে তার গরমিল ঘটছে।
অঞ্জু বাংলাদেশে জন্মেছিলেন কিনা, সেটা হয়তো সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি,
তবে তাঁর জন্মস্থান নিয়ে কিছু তথ্যগত অসঙ্গতি রয়েই গেছে।
অঞ্জু অতীতে যা বলেছেন
বুম বাংলাদেশি মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর তিনটি সাক্ষাত্কারের খোঁজ পেয়েছে, যেখানে অঞ্জু দাবি করেছেন—“তিনি বাংলাদেশের মেয়ে (সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান) এবং ওই দেশই তাঁর জন্মভূমি।”
প্রথম আলো সংবাদমাধ্যম সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে—“কে চায় না তার নিজের মায়ের কোলে ফিরে আসতে! হাজার হোক এটাই আমার জন্মভূমি!”
উল্লেখ্য, ইউ-টিউবে ভিডিওটির বিবরণীতে বলা হয়েছে, অঞ্জু বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মান এবং চট্টগ্রামে বড় হয়ে ওঠেন। বিবরণটি এই রকমঃ “চট্টগ্রামে বেড়ে উঠলেও অঞ্জু ঘোষের জন্ম ফরিদপুরে। অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে তাঁর সিনেমায় অভিনয় শুরু। প্রথম অভিনীত সিনেমা তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘আশীর্বাদ’।”
বুম প্রথম আলো’র প্রধান বার্তা-সম্পাদক সেলিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে চেয়েছে। তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেই প্রতিবেদনটি সংস্করন করা হবে।
দীর্ঘ ২২ বছর কলকাতায় কাটানোর পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিরে গিয়ে অঞ্জু ঘোষ বাংলাদেশের অন্যান্য চলচ্চিত্র শিল্পীদের সঙ্গে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। নীচের ভিডিওটিতে তাঁকে বলতে শোনা যাবেঃ “আজ এতদিন পরে আমি যে আমার মাতৃভূমিতে পা রাখলাম, সেটার পিছনে কোনও উদ্দেশ্য নেই। আমি এখানে সিনেমা করতে আসিনি কিংবা এখানকার চলচ্চিত্র শিল্প কেমন চলছে, সেটা দেখতেও আসিনি। আমি এসেছি একজন তীর্থযাত্রী হিসাবে।”
তার পরেই তিনি বলতে থাকেন—মাতৃভূমির একটা আলাদা টান আছে । এর পরেই তিনি তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র কথা উল্লেখ করেন, বক্স-অফিসে বিপুল জনপ্রিয় যে বাংলাদেশি ছবিটি আজও তাঁকে দর্শকদের চোখের মণি করে রেখেছে।
বুম বাংলাদেশ ফিল্ম আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিশা সওদাগরের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে, যিনি সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির ছিলেন। তাঁর উত্তর পাওয়া গেলেই প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করা হবে।
অন্য একটি অনুষ্ঠানে শোনা গেছে, অঞ্জু বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় ভাঙ্গা অঞ্চলে জন্মেছিলেন ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর।
শ্রীমতী ঘোষের একটি ফোসবুক পেজও ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকাতেই জন্মেছিলেন। পেজটির আর্কাইভ সংযোগটি (লিংক) দেখুন এখানে। অথচ মজার ব্যাপার হল, যখন তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, তার জবাব তিনি এড়িয়ে যান।
তা ছাড়া, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অঞ্জু ঘোষের যে জন্ম-সার্টিফিকেট দেখাচ্ছেন, তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর (২৯১৭) কলকাতা পুরসভায় সংরক্ষিত জন্ম-সার্টিফিকেটের নম্বরের (১১৩১) সঙ্গে মিলছে না।
বুম কলকাতার ইস্ট এন্ড নার্সিং হোম প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গেও যোগাযোগ করে, কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, জন্ম-সার্টিফিকেট কেবল কলকাতা পুরসভার সংশ্লিষ্ট দফতর থেকেই মিলতে পারে।
অন্তত ৫১ বার উইকিপিডিয়া পেজটি বদলানো হয়েছে
বুম দেখেছে, বিজেপিতে তাঁর যোগদানের কথা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে অঞ্জু ঘোষের উইকিপিডিয়া পেজটি ৫০ বারেরও বেশি বদলানো হয়েছে। ১৩ মে ২০১২-তে শ্রীমতী ঘোষের উইকিপিডিয়া পেজ-এ প্রথম তাঁর বয়সের উল্লেখ করা হয়।
তবে এই লেখার সময় পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ সম্পাদিত পেজটিতে জন্ম-তারিখের কোনও উল্লেখ নেই, যদিও জন্মস্থান হিসাবে ফরিদপুরের ভাঙা-র নামই রয়েছে।
সম্প্রতি রাজনৈতিক সভায় যোগ দেওয়ার দায়ে বাংলাদেশি অভিনেতাদের শাস্তি পেতে হয়েছে
অঞ্জু ঘোষের বিজেপিতে যোগদানের পর ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশি অভিনেতাদের রহস্যময় যোগসাজশের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। এই এপ্রিল মাসেই রায়গঞ্জের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার করতে দেখা যাওয়ায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা ফিরদৌস রহমানকে কেন্দ্র বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, তাঁর নাম কালো তালিকাভুক্তও করা হয়।
আর এক বাংলাদেশি অভিনেতা গাজি আবদুল নূরকেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পত্রপাঠ বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় যখন দেখা যায়, তিনি মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ভিসা নিয়েও তৃণমূল কংগ্রেসের মিছিলে যোগ দিয়েছেন।