কেরলে এক মুসলিম ব্যক্তি কি হাতিকে মাংস খাওয়াচ্ছেন? একটি তথ্য-যাচাই
বুম দেখে ভাইরাল ভিডিওটিতে হাতিটি তাদের দিকে তেড়ে আসার আগে বাবা ও ছেলে মিলে তাকে একটি নারকেল খেতে দিচ্ছিল।
কেরলের (Kerala) একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি লোক ও একটি বাচ্চা ছেলে নারকেল (Cocunut) দিচ্ছে একটি হাতিকে (Elephant)। কিন্তু পরমুহূর্তে সেটি তাদের দিকে তেড়ে আসে। ওই ভিডিওটি এই মিথ্যে ও সাম্প্রদায়িক দাবি সমেত শেয়ার করা হচ্ছে যে, এক মুসলমান ব্যক্তি ও তাঁর ছেলে হাতিটিকে মাংস (meat) খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। তার ফলে, হাতিটি রেগে গিয়ে তাঁদের দিকে তেড়ে আসে।
বুম নবীল কুনহাপ্পুর সঙ্গে কথা বলে। তাঁকে ও তাঁর বাচ্চা ছেলেকে ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে। উনি ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন যে, তাঁর ছেলে হাতিটিকে নারকেল খাওয়ানোর চেষ্টা করলে, সেটি তাঁদের দিকে ছুটে আসে। ভিডিওটিতেও আমরা বাচ্চাটির হাতে একটি নারকেলের মত জিনিস দেখতে পাই। সেটাই সে হাতিটিকে দিতে যাচ্ছিল।
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে বাচ্চার হাত ধরে এক ব্যক্তিকে একটি হাতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারপর হাতিটিকে খাওয়ানো চেষ্টা করলে, সেটি তেড়ে আসে তাঁদের দিকে। তবে লোকটি ও বাচ্চাটি, দু'জনেই নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যেতে পারেন।
যে ক্যাপশন সমেত ভিডিওটি শেয়ার করা হচ্ছে, তাতে লেখা হয়েছে, "হাতি একটি নিরামিষাশী প্রাণী, কিন্তু এই মুসলমানরা তাকে মাংস খাওয়াতে গেলে...দেখুন কী হয়।"
ভিডিওটি দেখুন এখানে।
ওই একই মিথ্যে ও সাম্প্রদায়িক দাবি সমেত ভিডিওটি ফেসবুকেও ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে।
তথ্য যাচাই
বুম দেখে, ভাইরাল ভিডিওটিতে বাবা ও ছেলে হাতিটিকে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেননি, যদিও তেমনটাই দাবি করা হচ্ছে। বাস্তবে, তাঁরা হাতিটিকে নারকেল দেন।
ভিডিওটিকে সূত্র ধরে আমরা কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করি ও রিভার্স ইমেজ সার্চও করা হয়। তার ফলে, ওই ঘটনা সংক্রান্ত মালয়ালম ভাষায় প্রকাশিত খবর দেখতে পাই। তাতে বাচ্চা সমেত ওই ব্যক্তিটিকে নবীল কুনহাপ্পু বলে শনাক্ত করা হয়। এবং বলা হয় যে, তাঁরা প্রথমে হাতিটিকে নারকেল দেন। এরপর তাঁর ছেলে, হাতিটিকে কিছু খাবার দেওয়ার জন্য বায়না ধরে। তখনই সেটি তঁদের আক্রমণ করে। খবরে আরও বলা হয়, ভিডিওটি পুরনো, কিন্তু সেটি এখন ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওটি দেখার সময় আমরা লক্ষ করি যে, হাতিটিকে খাওয়াতে যাওয়ার সময়, বাচ্চাটির হাতে নারকেলের মতো একটি লম্বাটে জিনিস রয়েছে।
নবীল কুনহাপ্পু, ৮ এপ্রিল ২০২২, তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। তাতে মালয়ালি ভাষায় উনি বলেন, তিনি হাতিটিকে নারকেল খাওয়ান। কিন্তু তাঁর ছেলেও তাকে খাওয়াবে বলে বায়না করে। তাঁরা দ্বিতীয়বার গেলে, হাতিটি তাঁদের তাড়া করে। কুনহাপ্পু আরও বলেন যে, তাঁর ছেলের একটু আঘাত লাগে। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার মতো গুরুতর ছিল না তার চোট।
বুম কুনহাপ্পুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তাঁরা হাতিটিকে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, এই সাম্প্রদায়িক দাবি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ২৩ অক্টোবর, ২০২১, মালাপুরম জেলার কিজহপরাম্বু পাজহপরাম্বু-তে তিনি ও তাঁর ছেলে হাতিটিকে নারকেল খাওয়ানোর চেষ্টা করলে, ঘটনাটি ঘটে।
কুনহাপ্পু এখন সৌদি আরবে কাজ করেন। তিনি একটি ভিডিও তুলে বুমকে পাঠান। ভিডিওটিতে উনি বলেন: "...ওই ভিডিওটিতে আমিই হলাম বাবা। এখন সেই ভিডিও মিথ্যে দাবি সমেত প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আমি হাতিটিকে গরুর মাংস দেওয়ার ও সেটিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করি। এটা খুবই হাস্যকর। সত্যটা কী, তা আমরা জানি।"
তিনি আরও বলেন: "ঘটনাটি ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবরের। সেই সময় আমার শাশুড়ি ও শ্যালক আমার বাড়ি তৈরির কাজ দেখতে এসেছিলেন। সেদিন আমার ছেলে, হাতি দেখতে যাওয়ার কথা বলে। নির্মাণ কর্মীরা দুপুর দুটো নাগাদ চলে গেলে, আমি আমার ছেলেকে হাতি দেখাতে নিয়ে যাব ঠিক করি। এবং আমরা সেখানে যাই।
"আমি যখন হাতিটিকে নারকেল দিতে যাই, আমার ছেলেও আমার সঙ্গে যেতে চায়। কিন্তু আমি তাকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলি। তাকে বলি, আমি প্রথমে যাব। এবং কিছু ঘটলে পালানোর জন্য যেন সে তৈরি থাকে। প্রথম ভিডিওটিতে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে," বলেন কুনহাপ্পু।
ঘটনাটি ঘটার আগে তোলা ভিডিওটিও আমাদের পাঠান কুনহাপ্পু। তাঁকে একা গিয়ে হাতিটিকে নারকেল খাওয়াতে দেখা যায় ওই ভিডিওটিতে। ভিডিওটি নীচে দেখুন।
কুনহাপ্পু আরও বলেন, "প্রথম নারকেলটি খাওয়ানোর সময় হাতিটি বেশ শান্ত ছিল। কিন্তু আমি ও আমার ছেলে যখন দ্বিতীয় নারকেলটি দিতে যাই, তখন সে নারকেলটির বদলে আমার ছেলেকে ধরে। এরপর হাতিটি আমার ছেলেকে মাটিতে ফেলে আমার পা ধরে। কিন্তু আমরা ভাগ্যবান ছিলাম। আমরা দু'জনেই বেঁচে যাই। আমাদের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই চেঁচিয়ে ওঠেন। বাড়ি থেকে সব লোকজন বেরিয়ে পড়েন। এবং তাঁরা ঘটনাটি জানতে পারেন। ঘটনাটির ছ'মাস পরে এখন সেটি ভাইরাল হয়েছে। আমি এখন সৌদি আরবে।"
মালয়ালম ভাষায় ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে কুনহাপ্পু যে ভিডিওটি বুমকে পাঠান, সেটি নীচে দেখুন।
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং সুজিথ এ)
আরও পড়ুন: বিভ্রান্তিকর দাবি—পাবজি আসক্তিতে হাসপাতালে কিশোরের গেম খেলার ভঙ্গিমা