প্রধানমন্ত্রীর ইএসির রিপোর্ট নিয়ে বিভ্রান্তিকর সাম্প্রদায়িক দাবি ছড়াল
বুম দেখে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে অতিরঞ্জিত করে দেখানোর জন্য ভাইরাল দাবির পরিসংখ্যানগুলি বাছাই করা হয়েছে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির ওয়ার্কিং পেপার কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিকর দাবিসহ একাধিক পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্টগুলিতে দাবি করা হচ্ছে যে রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার ৭.৮% হ্রাস এবং মুসলিম জনসংখ্যার ৪৩% বৃদ্ধি ঘটেছে। উপরন্তু, ফেসবুকের একাধিক পোস্টে এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিত যোগ করা হয়েছে।
বুম দেখে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বৃদ্ধি এবং প্রজননের হার হ্রাসের প্রবণতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করি মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে অতিরঞ্জিত করে দেখানোর জন্য ভাইরাল দাবির পরিসংখ্যানগুলি বাছাই করা হয়েছে।
বিজেপি আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য এই রিপোর্ট কেন্দ্র করে এক্সে পোস্ট করে ক্যাপশন হিসাবে লিখেছেন, “১৯৫০ থেকে ২০১৫ অবধি হিন্দুদের ভাগ ৭.৮% কমেছে। মুসলিম জনসংখ্যা ৪৩% বেড়েছে। এত দশকের কংগ্রেস শাসন আমাদের এই অবস্থা করেছে। অরা থাকলে, হিন্দুদের জন্য কোনও দেশই থাকতো না।” (অনূদিত)
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ফেসবুকে একজন ব্যবহারকারী পোস্টে ক্যাপশন হিসাবে লিখেছেন, “হিন্দু জেগে ঘুমাও ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে আর হিন্দু জনসংখ্যা কমছে…হিন্দুদের দেশ নেই নিজের আসে পাশে একটু খোঁজ নিলেই বোঝা যায় ভবিষ্যত অনিশ্চিত।”
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
পত্রিকায় কি লেখা আছে?
Prime Minister's Economic Advisory Council (PM-EAC) মে মাসে তাদের ওয়েবসাইটে Share of Religious Minorities: A Cross-Country Analysis (১৯৫০-২০১৫) শীর্ষক একটি ওয়ার্কিং পেপার প্রকাশ করেছে।
গবেষণাপত্রে ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারত সহ ১৬৭টি দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যার পরিবর্তনের হার খতিয়ে দেখা হয়েছে। শুরুতে, গবেষণাপত্রে দেখা যায় ভারতের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের অংশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৭.৮১% হ্রাস পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী গড়ের তুলনায় অনেক কম।সারা বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশ ২২% কমেছে।
ভারতের ক্ষেত্রে, গবেষণা পত্রটি রিপোর্ট করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৭.৮১% হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮৪.৬৮% থেকে ৭৮.০৬% এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে, মুসলিম জনসংখ্যার অংশ ১৯৫০ সালের ৯.৮৪% থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১৪.০৯% হয়েছে, অর্থাৎ মুসলিমদের অংশ ৪৩.১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষণার এই বিশেষ অংশটি বাদ দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ওপইন্ডিয়ার মতো দক্ষিণপন্থি ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্তিকর দাবি করে যে হিন্দু জনসংখ্যা ৭.৮% হ্রাস পেয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যা ৪৩% বৃদ্ধি পেয়েছে, পর্যাপ্ত তথ্য উল্লেখ না করে।
গবেষণাপত্রে উল্লিখিত আছে জনসংখ্যার ধর্মীয় গঠনের পরিবর্তন একটি "জটিল ঘটনা" এবং এর পিছনে দেশান্তর, ধর্মান্তর, প্রজনন হারের পার্থক্য এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলে আঞ্চলিক সীমানার পরিবর্তনের মতো বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। পত্রটিতে আরও জানানো হয়েছে, "আমরা এই পরিবর্তনের কারণগুলি থেকে সরে এসেছি এবং তার পরিবর্তে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার অংশকে তাদের সুস্থতার ক্রমবর্ধমান ফলাফলের পরিমাপ হিসাবে গণ্য করছি।"
গবেষণাটি উল্লেখ করে "সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হ্রাস অর্থাৎ ১৯৫০-২০১৫ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার অংশের পরিবর্তনের নেতিবাচক হার (এবং সংখ্যালঘু জনসংখ্যার অংশ বৃদ্ধি) থেকে আমরা ধরতে পারি দেশে বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য একটি সামগ্রিক অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।”
একই সময়ে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ শাসকদলের অন্যান্য নেতারা তাদের সাম্প্রতিক নির্বাচনী সমাবেশে মুসলমানদের "অনুপ্রবেশকারী" এবং "যাদের বেশি সংখ্যক সন্তান রয়েছে" হিসাবে উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িক ইঙ্গিতসহ বক্তৃতা দিয়েছেন।এছাড়াও, মোদী দাবি করেন কংগ্রেসের ইস্তাহারে মহিলাদের সোনা সহ দেশের সমস্ত সম্পত্তির একটি সমীক্ষার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হল মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তির পুনর্বণ্টন করা। কিন্তু বুম যাচাই করে দেখে দাবিটি বিভ্রান্তিকর, কারণ কংগ্রেসের ইস্তাহারে মুসলমানদের মধ্যে সম্পদ পুনর্বণ্টন করার কোনও উল্লেখ নেই।
উপরন্তু, গবেষণাপত্রে ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যার "ভাগের পরিবর্তনের হার" গণনা করার জন্য ব্যবহৃত গাণিতিক সূত্রটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পুরনো জনগণনার তথ্য বাছাই করে এবং ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে
গবেষণাপত্রে বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় জনসংখ্যার উপর ২০১৭ সালের একটি গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যা আবার Association of Religion Data Archives (ARDA) থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
যদিও এই তথ্যগুলি ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতের জনগণনা থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা, তবে ২০১৫ সালের তথ্য পূর্ববর্তী জনগণনা পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার অনুমান থেকে প্রাপ্ত। সর্বশেষ দশকব্যাপী জনগণনা ২০১১ সালে হয়েছিল এবং ২০২১ সালের জন্য নির্ধারিত পরবর্তী জনগণনা এখনও হয়নি।
প্রথমত, গবেষণাটি জনসংখ্যার ভাগের পরিবর্তন গণনা করার জন্য "ভাগের পরিবর্তনের হার" ব্যবহার করে। ভারতে ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ৭.৮২% হ্রাস পেয়েছে এবং মুসলমানদের সংখ্যা ৪৩.১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই গণনাটি ভুল নয়, তবে এটি মুসলিম, হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের জনসংখ্যার অংশের পরিবর্তনকে তুলে ধরার জন্য পরিসংখ্যানগতভাবে নির্দিষ্ট কোনও উপায় ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
একটি পরিসংখ্যানগতভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতি দিয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য শতাংশ পয়েন্টের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই ক্ষেত্রে, হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ৬.৬২ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে (১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট জনসংখ্যার ৮৪.৬৮% থেকে ৭৮.০৬%) এবং মুসলিম জনসংখ্যার অংশ ৪.২৫ শতাংশ পয়েন্ট (৯.৮৪% থেকে ১৪.০৯%) বেড়েছে।
এই পদ্ধতিটি মুসলিম জনসংখ্যার ভাগের পরিসংখ্যানকে অতিরঞ্জিত করা থেকে বিরত থাকে যা ইতিমধ্যেই হিন্দুদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
দ্বিতীয়ত, ইএসির গবেষণাপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি যে বিষয়টির উল্লেখ করেনি তা হল ১৯৫০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতের সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী বৃদ্ধি পেয়েছে।নিরঙ্কুশ সংখ্যায়, হিন্দু জনসংখ্যা দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে রয়ে গেছে। ১৯৫১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬ কোটি। এর মধ্যে মোট জনসংখ্যার ৮৪% বা ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল যেখানে মাত্র ৩.৫ কোটি বা মোট জনসংখ্যার ৯.৮% মুসলিম সম্প্রদায়ের ছিল।
২০১১ সালে হিন্দুদের জনসংখ্যা বেড়ে ৯৬.৬ কোটি এবং মুসলমানদের জনসংখ্যা বেড়ে ১৭.২ কোটিরও বেশি হয়। ভারতের সামগ্রিক জনসংখ্যায় হিন্দুদের অংশ ১৯৫১ সালে ৮৪% থেকে কমে ২০১১ সালে প্রায় ৭৮% হলেও, তারা দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে।
মুসলমানদের মধ্যে বৃদ্ধির হার এবং মোট প্রজনন হার হ্রাস
গত তিন দশকে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, ১৯৮১-১৯৯১ সালে ৩২.৯% থেকে ২০০১-২০১১ সালে ২৪.৬%। হিন্দুদের জন্য, বৃদ্ধির হার একই সময়ের মধ্যে ২২.৭% থেকে ১৬.৮% নেমেছে।
একইভাবে, সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার (টিএফআর) হ্রাস পাচ্ছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের মধ্যে হয়েছে, ১৯৯২ সালে মহিলা প্রতি ৪.৪ শিশু থেকে ২০১৯-২১ সালে, ভারতের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সার্ভে সর্বশেষ যে বছরের ধর্ম-ভিত্তিক তথ্য পাওয়া যায়, ২.৩৬ হয়েছে। হিন্দুদের মধ্যে একই সময়ে নারী প্রতি ৩.৩ শিশু থেকে ১.৯৪ শিশুতে নেমে এসেছে।
ইএসির গবেষণাপত্র সম্পর্কে গণমাধ্যমের ভুল প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পপুলেশন ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া (পিএফআই), একটি অলাভজনক সংস্থা যা জনসংখ্যার সমস্যাগুলি বিবেচনা করে উন্নয়নমুলক নীতির জন্য কাজ করে, বলে যে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সন্তান প্রসবের ব্যবধান কম হওয়া বোঝায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রজননের হার "একত্রিত" হচ্ছে বা আরও অনুরূপ হয়ে উঠছে।
এছাড়াও, পিএফআই আরও বলে বৃদ্ধি এবং প্রজননের হার ধর্মের সাথে নয় বরং শিক্ষা এবং আয়ের সাথে যুক্ত। উচ্চ স্তরের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ রাজ্যগুলিতে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে টিএফআর কম থাকার প্রবণতা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তারা বলে কেরালার মুসলিম মহিলাদের মধ্যে টিএফআর (২.২৫) বিহারের হিন্দু মহিলাদের মধ্যে টিএফআরের (২.৮৮) চেয়ে কম।
পিএইচআই জানায় ইএসির গবেষণা ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর অংশের পরিবর্তন নিয়ে করা হয়েছে এবং এটি "কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয় বা বৈষম্য উস্কে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়"।