না, লুক মন্ট্যানিয়ের বলেননি কোভিড টিকা নিলে দু'বছরের মধ্যে মারা যাবেন
লুক মন্ট্যানিয়ের আগে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের উৎস ও টিকাকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
একটি ভাইরাল হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় বলা হয়েছে যে, ফরাসি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ড. লুক মন্ট্যানিয়ের (Luc Montagnier) নাকি বলেছেন যে, কোভিড-১৯-এর টিকা (COVID19 Vaccine) যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা দু' বছরের মধ্যে মারা যাবেন। কিন্তু দাবিটি মিথ্যে ও বিভ্রান্তিকর।
'লাইফসাইটনিউজ.কম'কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটিতে। কিন্তু সেই লেখায় মন্ট্যানিয়ের কোথাও বলেননি যে, কোভিড-১৯ টিকা নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা দু'বছরের মধ্যে মারা যাবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনজিও 'আরএআইআর ফাউন্ডেশন' ১৮ মে ২০২১ তাঁর সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে্। পরে, ২৫ মে, তাঁরা একটি লেখা প্রকাশ করেন। কোভিড-১৯ টিকা যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা দু' বছরের মধ্যে মারা যাবেন, মন্ট্যানিয়ের এ কথা বলেছেন বলে যে দাবিটি করা হচ্ছে, সেটি নস্যাৎ করা হয় ওই লেখাটিতে। তাতে স্পষ্ট বলা হয়, মন্ট্যানিয়ের সে রকম কথা বলেননি।
এপ্রিল ২০২০তে মন্ট্যানিয়ের খবরের শিরোনামে উঠে আসেন, কারণ উনি বলেন যে, সার্স-কভ-২ বা নভেল করোনাভাইরাস মানুষের তৈরি। এবার উনি বলেছেন যে, টিকা দেওয়ার ফলে, ভাইরাসটির নতুন নতুন মিউট্যান্ট বা স্ট্রেন তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়াকে 'অ্যান্টিবডি মেডিয়েটেড এনহ্যান্সমেন্ট' বা 'অ্যান্টিবডি-নির্ভরবৃদ্ধি' বলা হয় যার ফলে, দীর্ঘ মেয়াদে, টিকার কার্যকারিতা লোপ পায়। অন্যান্য ভাইরোলজিস্টরা তাঁর এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছেন, এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিষেধক নেওয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করবেন।
তাঁর ওই বক্তব্য ছিল ফরাসিতে 'হোল্ড আপ মিডিয়া'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশ। ওই সাক্ষাৎকারের একটি ছোট, অনুবাদ-করা অংশ দেওয়া হয়েছিল আরএআইআরকে।
আরও পড়ুন: না, বিবিসি খবরে বলেনি মিউকোরমাইকোসিসের নেপথ্যে গোমূত্রের যোগ
ভাইরাল মেসেজটিতে মন্ট্যানিয়েরের উইকিপিডিয়া পেজ ও লাইফসাইটনিউজ.কম-এর লেখার লিঙ্ক দিয়ে বলা হয়:
"টিকা-প্রাপ্ত সব মানুষ দু'বছরের মধ্যে মারা যাবেন।
নোবেলজয়ী লুক মন্ট্যানিয়ের জোরের সঙ্গে বলেছেন যে, যাঁরা এই ভ্যাক্সিন নিয়েছেন, তাঁদের বাঁচার কোনও আশা নেই। স্তম্ভিত করার মত ওই সাক্ষাৎকারে, বিশ্বের প্রথমসারির ওই ভাইরোলজিস্ট কোনও রাখঢাক না করে বলেন, 'যাঁদের ইতিমধ্যেই টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কোনও আশা নেই। কোনও সম্ভাব্য চিকিৎসাও নেই। সেই সব মরদেহ পোড়ানর জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।' টিকার উপাদানগুলি বিশ্লষণ করার পর, এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, অন্যান্য খ্যাতনামা ভাইরোলজিস্টদের দাবিকে সমর্থন করেন। 'তাঁরা সবাই অ্যান্টিবডি-নির্ভর বৃদ্ধির কারণে মারা যাবেন। কিছুই বলার নেই', উনি বলেন।"
" 'এটি একটি মারাত্মক ভুল, তাই না? বৈজ্ঞানিক ভুল আর চিকিৎসাগত ভুল। এই ভুল অমার্জনীয়,' গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরএআইআর ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও প্রকাশ করা সাক্ষাৎকারে, মন্ট্যানিয়ের একথা বলেন। 'ইতিহাসের বই একদিন সে কথাই বলবে। কারণ, টিকা দেওয়ার ফলেই নতুন স্ট্রেনগুলি তৈরি হচ্ছে। অনেক ভাইরোলজিস্ট এ কথা জানেন কিন্তু অ্যান্টিবডি-নির্ভর বৃদ্ধির সমস্যাটি সম্পর্কে তাঁরা 'চুপ' করে আছেন,' বলেন মন্ট্যানিয়ের।"
সাক্ষাৎকারে মন্ট্যানিয়ের কি বলেন, দু' বছরের মধ্যেই মৃত্যু হবে?
আরএআইআর ফাউন্ডেশনের শেয়ার করা দু'মিনিটের ক্লিপে ২০০৮-এর এই নোবেলজয়ী, করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনাকে একটি 'অমার্জনীয় ভুল' বলে উল্লেখ করেন। উনি আরও বলেন যে, ব্যাপকহারে টিকাকরণ একটি "বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাগত ভুল। ইতিহাস বই তাই বলবে। কারণ, টিকা দেওয়ার ফলেই নতুন স্ট্রেনগুলি সৃষ্টি হচ্ছে।"
টিকা দেওয়ার ফলেই নতুন স্ট্রেনগুলি তৈরি হচ্ছে, তাঁর এই মন্তব্য বৈজ্ঞানকি ভাবে বিতর্কিত হলেও, মন্ট্যানিয়ের কোথাও এ কথা বলেননি যে, যাঁরা প্রতিষেধক নিয়েছেন, তাঁরা দু' বছরের মধ্যে মারা যাবেন।
গোটা সাক্ষাৎকারটি টিকার ভূমিকা ঘিরেই ছিল। একমাত্র সংক্রমণ বৃদ্ধির গ্রাফের রেখা ও তার গতিপ্রকৃতির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মন্ট্যানিয়ের মৃত্যুর বিষয়টি উত্থাপন করেন। উনি বলেন, সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহারও বাড়ে ও একটা মৃত্যু-গ্রাফও তৈরি হয়। "নতুন স্ট্রেনগুলি টিকা দেওয়ার ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে। দেখুন, প্রতিটি দেশে, টিকাকরণের গ্রাফ যতটা উঠেছে, মৃত্যুর গ্রাফও সেই অনুপাতে বেড়েছে," বলেন মন্ট্যানিয়ের।
আরআইএআর টুইটের মাধ্যমে ও একটি লেখা প্রকাশ করে জানায় যে, প্রফেসর কখনওই বলেননি যে, টিকা নেওয়ার ফলে, দু'বছরের মধ্যে মারা যাবেন কোনও ব্যক্তি। বুম ভিডিওটির ইংরেজি প্রতিলিপি খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত হয় যে, মন্ট্যানিয়ের কোনও দু'বছরের সময়সীমার কথা উল্লেখ করেননি।
তাঁর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য বুম মন্ট্যানিয়েরকে লিখেছেন। তাঁর উত্তর পেলে, এই লেখা আপডেট করা হবে।
মন্ট্যানিয়েরকে ঘিরে বিতর্ক
২০০৮-এ ফিজিওলজি বা চিকিৎসাশাস্ত্রে ফ্রাঁসোয়াস বার্রে সিনুসি ও হারাল্ড জুয়ার হাউসেন-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে নোবেল প্রাইজ পান মন্ট্যানিয়ের। এইডস সৃষ্টিকারী এইচআইভি ভাইরাস আবিষ্কার করার জন্য তিনি নোবেল প্রাইজ পান।
এপ্রিল ২০২০তে, উনি দাবি করেন যে, সার্স-কভ-২ ভাইরাস গবেষণাগারে তৈরি করা হয়। তার জন্য উনি সমালোচনার মখে পড়েন। তার আগে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার দু'বছরের মধ্যেই, ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত করার নতুন উপায় নিয়ে গবেষণা করার জন্যও তিনি বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। ওই গবেষণা উনি হোমিওপ্যাথির তত্বের ওপর ভিত্তি করে করছিলেন। ২০১০-এ, লিনডাউতে নোবেল প্রাপকদের সমাবেশে, উনি ওনার ওই গবেষণার তথ্য পেশ করলে, অনেকেই বিস্মিত হন। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের অনুসারীরা মনে করেন মন্ট্যানিয়ের হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে প্রচার করার জন্য প্ল্যাটফর্মটিকে ব্যবহার করেছেন। হোমিওপ্যাথিকে এখনও একটি সনাতনী চিকিৎসা পদ্ধতি বলে মনে করা হয়।
টিকার বিরুদ্ধে মন্ট্যানিয়ের এই প্রথম মত প্রকাশ করলেন, তা নয়। ২০১২ তে, উনি 'অটিজিমওয়ান' নামের একটি সংস্থার আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় মূল বক্তা ছিলেন। ওই সংস্থাটি মনে করে যে, টিকা দেওয়ার ফলেই শিশুদের মধ্যে অটিজিম-এর মত প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।
তাঁর সাক্ষাৎকার কি তথ্যের দিক থেকে সঠিক ছিল?
সাক্ষাৎকারটিতে মন্ট্যানিয়ের বারবারই বলেছেন যে, টিকার ফলে নতুন নতুন স্ট্রেন তৈরি করে ও অ্যান্টিজেন-নির্ভর বৃদ্ধি দেখা দেয়।
ভারতীয় ভাইরোলজিস্ট ও ন্যাশনাল টেকনিক্যাল গ্রুপের সদস্য ড. গগনদীপ কাঙ্গ মন্ট্যানিয়েরের দাবি সম্পর্কে টুইট করেন।
তথ্য যাচাই সংস্থা 'ফ্যাক্টচেকার', মন্ট্যানিয়েরের দাবি সম্পর্কে জানতে ভারতের ভাইরোলজিস্ট ড. টি জেকব জন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভারসিটির জন স্নো প্রফেসর অফ এপিডিমিওলজি ও নিউরোলজি এবং প্যাথোলজির প্রফেসর ডাব্লিউ ইয়ান লিপকিন-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে।
অতিমারির সময় টিকা দেওয়া ঠিক নয়, এই বক্তব্য সম্পর্কে জন বলেন 'এ এইচ১এন১' ইনফ্লুয়েনজা 'এ এইচ৩এন২' ইনফ্লুয়েনজার 'বি' ভাইরাস, স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত, রিন্ডারপেস্ট ও এমনকি পোলিওর ক্ষেত্রে টিকা কার্যকর হয়েছে।
"আমরা হাম, রুবেলা, মাম্পস, ভারিসেলা (চিকেনপক্স), হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, রোটাভাইরাস, জাপানি এনকেফেলাইটিস ও জরায়ুতে ক্যানসার সৃষ্টিকারী প্যাপিলোমা ভাইরাস-এর ক্ষেত্রে টিকা ব্যবহার করেছি। তাতে কোনও সমস্যা দেখা দেয়নি। এই সব অসুখের বিরুদ্ধে নানা দেশে, নানা বয়সের মানুষের মধ্যে টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ইনফ্লুয়েনজার প্রতিষেধক তো ১৯৪৫ থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। তার ফলে, হাজার হাজার শিশু, বয়স্ক মানুষ ও গর্ভবতী মহিলার প্রাণ বাঁচানো গেছে প্রতি বছর। ওই অবাঞ্ছিত খবরে যা দাবি করা হয়েছে, টিকা কখনওই সেই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেনি," বলেন জন।
লিপকিন অ্যান্টিবডি-নির্ভর বৃদ্ধির বিষয়টা বুঝিয়ে বলেন। ই-মেলের মাধ্যমে লিপকিন ফ্যাক্টচেকারকে জানান, "অ্যান্টিবডি যদি ভাইরাসকে প্রতিহত করতে না পারে, তা হলে ফল খারাপ হতে পারে। কারণ, তখন যে সব কোষ সংক্রমিত হয়নি, সেগুলিতেও ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটিকেই অ্যান্টিবডি-নির্ভর বৃদ্ধি বলা হয়।"
উনি আরও বলেন, "টিকা অ্যান্টিবডি-নির্ভর বৃদ্ধি ঘটায় না। কারণ, সেগুলি এমন ভাবে তৈরি করা হয় যাতে, ভাইরাস প্রতিহত করার মত অ্যান্টিবডি (ও টি-সেল-এর প্রতিক্রিয়া) সেগুলি তৈরি করতে পারে। যে সব ভাইরাস বেঁচে যায়, বিবর্তন সেগুলিকে সাহায্য করে। কিন্তু এই জন্য টিকা ব্যবহার করা ঠিক নয়, আমার মতো অনেক বিজ্ঞানী তা মনে করেন না। বরং আমরা মনে করি, এই জন্যই যত বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যায় ততই ভাল, যাতে সার্স-কভ-২ প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ না পায়। আমি দুঃখিত যে, এই বিষয়ে আমি প্রফেসর মন্ট্যানিয়েরের সঙ্গে এক মত হতে পারলাম না।"
আরও পড়ুন: সাইক্লোন ইয়াস: জলের তোড়ে ভাসছে গাড়ি দৃশ্যটি ২০১৭ সালের কলম্বিয়ার