বাংলাদেশে মন্দির ভাঙচুর দাবিতে ভাইরাল পশ্চিমবঙ্গে কালীমূর্তি নিরঞ্জনের ভিডিও
বুমকে বর্ধমান সুলতানপুরের কালী পুজো কমিটির এক সদস্য জানান, ভিডিওটিতে তাদের পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্য দেখা যায়।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু মানুষের এক কালীমূর্তি (Kali Idol) ভেঙে ফেলার ভিডিও শেয়ার করে ব্যবহারকারীরা দাবি করেন, ভিডিওটিতে বাংলাদেশের (Bangladesh) এক হিন্দু মন্দিরে হামলা এবং মূর্তি ভাংচুরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
বুম যাচাই করে দেখে, ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার সুলতানপুরের। বর্ধমান সুলতানপুরের কালী পুজো কমিটির সদস্য দেবাশিস মণ্ডল বুমকে নিশ্চিত করে জানান, ভিডিওটিতে তাদের ঐতিহ্যবাহী কালীপুজোর ১২ বছর অন্তর প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্য দেখা যায়। তিনি এই দৃশ্য কোনও মন্দিরে সাম্প্রদায়িক হামলার নয় বলেও নিশ্চিত করেন।
২ মিনিটের ভাইরাল সেই ভিডিওতে একজন ব্যক্তিকে অন্যজনের কাঁধের উপর ভর দিয়ে কালী মূর্তির মাথাটি ভেঙে ফেলতে দেখা যায়। কালী প্রতিমা ভাঙার পাশাপাশি ওই ভিডিওতে আরও দুটি ভাঙা মূর্তিও লক্ষ্য করা যায়।
এই ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার মুখপাত্র অচিন্ত্য মন্ডল এক্স হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখেন, "বাংলাদেশে এভাবে একের পর এক হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলছে জিহাদিরা। উল্টোদিকে আমরা ভারতীয় হিন্দুরা বসে বসে মজা দেখি আর ঘুমাই!! কারণ ওগুলো তো বাংলাদেশের হচ্ছে!! ভারতে হলে তারপর দেখা যাবে!!"
আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ফেসবুকেও এক ব্যবহারকারী ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে দাবি করে, "দেখুন গতকাল বাংলাদেশে কিভাবে মুসলমানরা কালী মন্দিরে হা*ম"লা চালিয়ে মা কালীর মূর্তি সহ অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে...এভাবে একের পর এক হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলছে মুসলমান জি*হা*দিরা...উল্টোদিকে আমরা ভারতীয় হিন্দুরা বসে বসে মজা দেখছি আর ঘুমাচ্ছি কারণ ওগুলো তো বাংলাদেশের হচ্ছে..."।
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙচুর নয়, বর্ধমানে কালীমূর্তি বিসর্জনের ভিডিও
বুম প্রথমে গুগলে সম্পর্কিত কিওয়ার্ড সার্চ করে দৈনিক স্টেটসম্যানের ২১ অক্টোবর, ২০২৪-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভাইরাল ভিডিওর অনুরূপ প্রেক্ষাপটে একটি কালী মূর্তির ছবি দেখতে পায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ছবিটি পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ ব্লকের সুলতানপুরের ঐতিহ্যবাহী কালীমূর্তির ছবি।
প্রতিবেদন অনুসারে, এই ৬০০ বছরের পুরনো কালীপুজোর অভিনবত্ব ধরা পরে তাদের ১২ বছর অন্তর মা কালীর প্রতিমা নিরঞ্জন করার রীতিতে। তাছাড়াও, মা কালী এখানে দুর্গার চার ছেলেমেয়ে— লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ এবং জয়া ও বিজয়া সহিত পূজিতা হন। ১২ ফুটের বিশাল কালী প্রতিমার নিত্য পুজো হয় ১২ বছর ধরে এবং এই বছর পরম্পরা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জন হবে যা দেখতে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।
দৈনিক স্টেটসম্যান জানায়, সুলতানপুরের এই কালীপূজো কামার সম্প্রদায়ের মানুষ প্রথম চালু করে ৬০০ বছর আগে। পরে, তারা এই পুজোর দায়িত্ব মণ্ডল পরিবারের হাতে তুলে দেন এবং তারাই এই পুজো করে আসছে। বর্তমানে, গ্রামের প্রতিটি পরিবার মিলেই এই পুজোর আয়োজন করে।
এরপর, আমরা ফেসবুকে সুলতানপুরের কালী মূর্তি নিরঞ্জন সম্পর্কিত কিওয়ার্ড সার্চ করে এক ফেসবুক ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টে ভাইরাল ভিডিওটি দেখতে পাই। ওই ব্যবহারকারী ২৯ নভেম্বর, ২০২৪-এ করা পোস্টের ক্যাপশনে লিখেছেন, "#সুলতানপুরকালিমাতানিরঞ্জন।"
আর্কাইভ দেখুন এখানে।
একটি ফেসবুক পেজে ২৭ নভেম্বর আপলোড করা সুলতানপুরের কালী প্রতিমা নিরঞ্জন রীতির এক দীর্ঘতর ভিডিও দেখুন এখানে।
সুলতানপুর পুজো কমিটির বক্তব্য
এরপর, আমরা সুলতানপুর কালী পূজা কমিটির সদস্য দেবাশিস মণ্ডলের সঙ্গে ভিডিওটির ব্যাপারে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের নিশ্চিত করে জানান ভিডিওটি এবছরের ২৬ নভেম্বরে হওয়া তাদেরই পুজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের।
দেবাশিস মণ্ডল বুমকে বলেন, "আমাদের কালী পুজো ২০০ থেকে ৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো। মায়ের (কালী) এইভাবেই ১২ বছর অন্তর অঙ্গহানি করে বিসর্জন জয়। কয়েক ঘণ্টা আগে অন্য জায়গায় একটি ঘটে মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। তারপর, প্রথমে একজন ব্রাহ্মণ মায়ের আঙুলের অঙ্গহানি করেন এরপর, দেউলিরা এবং শেষে গ্রামের লোকজন এই রীতিতে অংশ নেয়।"
এইভাবে বিসর্জনের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, "মূর্তিটি বিশাল বড়, দরজা দিয়ে বের করা যায় না এবং মায়ের ইচ্ছায় মূর্তির দৈর্ঘ্য কমানো সম্ভব নয়।"
দেবাশিস আরও জানান মা কালী নিজেই নাকি স্বপ্নাদেশ দিয়ে এইভাবে অঙ্গহানি করে বিসর্জন করতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, "হাটকৃষ্ণ নগরের একটি পরিবার বংশ পরম্পরায় সুলতানপুরের কালীমূর্তি তৈরি করে আসছে এবং তারা ওই মন্দিরে এসেই ১২ বছর অন্তর হাতে করে মূর্তি গড়ে দিয়ে যান।"
বুম তার কাছে ভিডিওটির সঙ্গে জড়িত সাম্প্রদায়িক দাবির কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি সেই দাবি নস্যাৎ করে বলেন, "সবাই মিলে সুলতানপুরে এই পুজো করা হয়। বাংলাদেশ বা মন্দির ভাঙচুরের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।।"
(অতিরিক্ত রিপোর্টিং: শ্রীজিৎ দাশ)