নভজ্যোত সিংহ সিধুর ডায়েটের মাধ্যমে ক্যানসার নিরাময়ের দাবি বিভ্রান্তিকর
ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বুমকে বলেন খাদ্যাভাসে পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে শরীরের উন্নতি করলেও ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ ও নিরাময়ে তার কার্যকরিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে।
প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং কংগ্রেস নেতা নভজ্যোত সিংহ সিধু (Navjot Singh Sidhu) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন তার স্ত্রী নভজ্যোত কৌর সিধু (Navjot Kaur Sidhu) স্টেজ-৪ স্তন ক্যানসারের (Breast Cancer) সাথে লড়াই করার পরে এখন সম্পূর্ণ ক্যানসার মুক্ত। সিধুর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনের কিছু ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
ভাইরাল ভিডিওতে সিধুকে বলতে শোনা যায় তার স্ত্রীর ডায়েটে লেবুর জল, কাঁচা হলুদ, আপেল সিডার ভিনেগার, নিম পাতা, তুলসী পাতা এবং কিনোয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিধু দাবি করেন এই ডায়েট তার স্ত্রীকে মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে ক্যানসার থেকে সারিয়ে তোলে।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বুমকে বলেন খাদ্যাভাসে পরিবর্তন যেমন নিয়মিত উপবাস এবং লেবুর জল, নিম, হলুদ, আপেল সিডার ভিনেগারের মতো খাবার খাওয়া সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করলেও ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ, নিরাময়ে তা কতটা কার্যকর এবিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। তারা জানান, ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপির অন্য কোনও প্রমাণিত বিকল্প নেই।
সিধু জানান তার স্ত্রী বিশেষ খাদ্যাভাস অনুসরণ করা ছাড়াও, অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি এবং টার্গেট থেরাপি সহ ক্যানসারের বিভিন্ন চিকিৎসা করেছেন। তবে, ভাইরাল ভিডিওয় তার ক্যান্সারের অন্যান্য চিকিৎসার কথা উল্লেখ নেই, বরং শুধুমাত্র তার খাদ্যাভ্যাসের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে।
সিধু সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংরেজি এবং হিন্দিতে তার স্ত্রীর চার পৃষ্ঠার ২৩ ধাপের ডায়েট প্ল্যানও শেয়ার করেছেন।
প্রাক্তন ক্রিকেটারের এই ঘোষণার পর, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যানসারের চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল তথ্য এবং অর্ধসত্য ভাইরাল হয়েছে। এদিকে, চিকিৎসক সম্প্রদায় ক্যানসারের নিরাময় বিষয়ে সিধুর দাবি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বুম ক্যানসার নিরাময় হিসাবে সিধুর উল্লিখিত বিশেষ ডায়েটের কার্যকরিতা যাচাই করার জন্য ক্যানসারের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়।
লেবুর জল, হলুদ, আপেল সিডার ভিনেগার ইত্যাদি কি ক্যানসারের চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারে?
"লেবুর জল বা আপেল সিডার ভিনেগার খেলে গ্যাস্ট্রিক পরিবেশকে ক্ষারীয় করে তোলে যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং ইনসুলিন ও গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে— এই তত্ত্বের ভিত্তিতে মানুষকে সকালে খালি পেটে ওই খাবারগুলি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী অম্লীয় পরিবেশে ক্যানসার কোষ বৃদ্ধি পায়। এই ত্বত্তের থেকেই শরীরকে ক্ষারীয় করে তুললে ক্যানসারের বৃদ্ধি বন্ধ হতে পারে ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছে। তবে, সত্য এটাই এই ধরণের দাবির কোনও প্রমাণিত তথ্য নেই ", বুমকে বলেন ডাক্তার মঞ্জুলা রাও, চেন্নাইয়ের থারমানির অ্যাপোলো প্রোটন ক্যান্সার সেন্টারের স্তন অনকোপ্লাস্টিক সার্জারির পরামর্শদাতা।
যদিও এই খাবারগুলি সাধারণত স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, তবে এগুলি ক্যানসারের প্রতিরোধ করে, পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে বা নিরাময় করে এমন কোনও প্রমাণ নেই। তিনি বলেন, "যদি এই ধরনের প্রমাণ থাকতো, তাহলে আমরা আমাদের সমস্ত রোগীর কাছে একই পরামর্শ দিতাম।"
ক্যানসারের চিকিৎসায় হলুদ বা কারকিউমিনের ভূমিকা নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। হলুদ তার প্রদাহরোধী এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। তবে, বুমের পর্যবেক্ষণ করা কোনও গবেষণায় হলুদ মানুষের মধ্যে ক্যানসার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করতে পারে এমন কোনও স্পষ্ট প্রমাণ মেলে না।
ডাঃ রাও এই বিষয় বলেন, "হলুদের স্বাস্থ্যে সম্ভাব্য উপকারিতা জানার জন্য গবেষণা করা হচ্ছে। তবে, এটির ক্যানসারের নিরাময় করার বা তার পুনরাবৃত্তি রোধ করার কোনও প্রমান নেই। চলমান গবেষণার লক্ষ্য এর উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা খতিয়ে দেখা, কিন্তু এখনও পর্যন্ত, ভাইরাল দাবিগুলিকে সমর্থন করার মতো কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।"
চিনি খাওয়া বাদ দেওয়া এবং নিয়মিত উপবাস করা
নিয়মিত উপবাস বা চিনি খাওয়া বাদ দেওয়া ক্যানসার নিরাময় করতে পারে এমন দাবি ভুয়ো। "নিয়মিত উপবাস ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে ও রোগীর শরীরে কেমোথেরাপির বিষাক্ততা হ্রাস করতে পারে, তাদের শক্তি, কেমো সহ্য করার ক্ষমতা এবং স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। তবে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের অন্যান্য ক্যান্সার ইত্যাদির রোগীদের মধ্যে নিয়মিত উপবাসের পরামর্শ দেওয়া হয় না। এছাড়াও, চিনি বা দুগ্ধজাত খাবার বাদ দেওয়া সম্পূর্ণরূপে ক্যানসার নিরাময়ে সাহায্য করে এমন কোনও প্রমাণ নেই", ব্যাখ্যা করেন ডাঃ রাও।
ডায়েট বা ডায়েটের নিয়মে যে কোনও পরিবর্তন ক্যানসার চিকিৎসক এবং অনকো-ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করে করতে হয়। তিনি বলেন, এই ধরনের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনগুলি বিদ্যমান ক্যানসার চিকিৎসার পরিপূরক হতে পারে কিন্তু তা প্রতিস্থাপন করতে পারে না। ক্যানসারের চিকিৎসায় অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি এবং/অথবা রেডিয়েশন থেরাপির সংমিশ্রণ অন্তর্ভুক্ত।
একইভাবে, দিল্লির শালিমার বাগের ফোর্টিস হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসক এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডাঃ বিনীত গোবিন্দ বলেন ক্যানসারের উপর নিয়মিত উপবাসের প্রভাব সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। "আমি আমার অধীনের রোগীদের বলি যদি তারা পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি গ্রহণ করে তবেই নিয়মিত উপবাসের অনুমতি দেওয়া হবে। পুষ্টির বিনিময়ে এটি করা উচিত নয়। তবে, এটির ক্যানসার প্রতিরোধ বা নিরাময় করার কোনও প্রমাণ নেই।"
ক্যানসার রোগীর কোন খাবারগুলি খাওয়া করা উচিত?
ডাঃ গোবিন্দর মতে, ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করা রোগীর বেশি পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা আছে, এবং তিনি প্রতিদিন শরীরের ওজনের কেজি প্রতি ১-১.৫ গ্রাম প্রোটিনসহ একটি সুষম ডায়েটের পরামর্শ দেন।
ডাঃ রাও বলেন, "ওজনের সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, কেমোথেরাপির সময় একটি স্থিতিশীল ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
ওজন বৃদ্ধি এবং ওজন হ্রাস উভয়ই এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অত্যধিক ওজন হ্রাস ক্যাচেক্সিয়া বা পেশী নষ্ট হওয়ার কারণও হতে পারে। যদিও এটি অন্যান্য অঙ্গের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় তবে, স্তন ক্যানসার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে এক্ষেত্রেও ক্যাচেক্সিয়া হতে পারে। এটি এড়িয়ে চলতে, একটি সুষম, প্রোটিন সমৃদ্ধ ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রোটিন পেশী সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে, শক্তি সরবরাহ করে এবং শক্তি বাড়ায়, তিনি ব্যাখ্যা করেন।
উভয় চিকিৎসকই রোগীদের জন্য হালকা থেকে মাঝারি কার্ডিও ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যারা ওজন তুলতে সক্ষম তাদের জন্য শক্তি প্রশিক্ষণের পরামর্শ দেন।
ডাঃ রাও ভারতীয় গবেষকদের ২০১৭ সালের একটি গবেষণার কথাও উল্লেখ করেন যা জার্নাল অফ ক্লিনিকাল অনকোলজিতে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণায় দেখা যায় যোগব্যায়াম করায় বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য না দেখা গেলেও, এটি ক্লান্তি, ব্যথা এবং মানসিক যন্ত্রণা কমায়। গবেষণায় দেখা যায় , "যোগব্যায়াম একটি কম ঝুঁকিপূর্ণ, কম খরচের পরিপূরক থেরাপি যা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের প্রতিদিনের ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে উন্নতি করতে পারে।"
ক্যানসারের পুনরাবৃত্তিতে খাদ্য কি ভূমিকা পালন করে?
আমরা উভয় চিকিৎসককেই জিজ্ঞাসা করি চিনি বা পরিশোধিত খাবার খেলে ক্যানসারের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি বাড়ে কিনা, বা নির্দিষ্ট কোনও খাবার ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে কিনা।
তাদের মতে, কোনও নির্দিষ্ট খাবার ক্যানসারের কারণ বা নিরাময় নয়। তবে, ডাঃ রাও জানান বেশি মাত্রায় প্রসেসড খাবার খাওয়া থেকে অতিরিক্ত চর্বি ইনসুলিন প্রতিরোধ করতে পারে, যা একজন মহিলার ক্যান্সার হওয়ার বা পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি বলেন, "এটি বিশেষ করে রজোনিবৃত্তি পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে সত্য, কারণ চর্বি কোষগুলি ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে, যা স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত একটি হরমোন। অতএব, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মহিলাদের ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ক্যানসার ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।"
উপরন্তু, যে মহিলারা ধূমপান করেন বা অ্যালকোহল পান করেন তাদের ক্যানসার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি বেশি থাকে, তারা যে পরিমাণ ধূমপান করেন বা পান করেন তার অনুপাতে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি 'টিউমার জীববিজ্ঞান' বা টিউমারের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে যার অর্থ প্রতিটি টিউমার আলাদা।
ডাঃ রাও ব্যাখা করেন, "উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের ওপিডিতে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ১০ জন মহিলা থাকেন, তবে তাদের প্রত্যেকে স্বল্প ভিন্ন আলাদা চিকিৎসা পাবেন। একজন প্রথমে কেমোথেরাপি পাবেন, একজনের আগে অস্ত্রোপচার হবে। তাই কেমো রেজিমেন সকলের জন্য আলাদা হবে কারণ তাদের টিউমারের প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই আমরা টিউমারের আচরণ, চিকিৎসা এবং পূর্বাভাস নির্ধারণের জন্য হরমোন রিসেপ্টর এবং হার-২ নিউ প্রোটিনের মতো কিছু জৈবিক মার্কার পরীক্ষা করি।"
আক্রমণাত্মক ক্যানসারের প্রথম ৩-৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি থাকে, আবার লুমিনাল ক্যানসারে মতো কম আক্রমণাত্মক প্রকারগুলি ১০ বছর পরও পুনরাবৃত্তি করতে পারে। পুনরাবৃত্তি মূলত চিকিৎসার ধরন, অস্ত্রোপচার এবং কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপির কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে।
এছাড়াও, ডাঃ সি এস প্রমেশ, টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পরিচালক এবং ২৬২ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ (বর্তমান ও প্রাক্তন) নভজ্যোত সিং সিধুর দাবি প্রমাণিত নয় বলে একটি বিবৃতি জারি করে বলেছেন তাদের সমর্থনের করার জন্য কোনও প্রমাণ বা নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।
তারা উল্লেখ করেন প্রাকৃতিকভাবে উপলব্ধ দ্রব্যগুলির উপর যদিও গবেষণা চলছে, তবে ক্যানসারের চিকিৎসা হিসাবে তাদের সুপারিশ করার জন্য কোনও ক্লিনিকাল তথ্য নেই।
বিবৃতিতে তারা বলেন, "আমরা জনসাধারণকে অপ্রমাণিত প্রতিকারগুলি অনুসরণ করে তাদের চিকিৎসা বিলম্বিত না করার আহ্বান জানাই, বরং ক্যানসারের কোনও লক্ষণ থাকলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিই।"
তারা ফের বলেন, অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপির মতো প্রমাণিত চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসার তাড়াতাড়ি সনাক্ত করা গেলে নিরাময় করা যেতে পারে।