পহেলগাঁও: হামলাকারীর এক্সক্লুসিভ ছবি বলে সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করল পুরনো দৃশ্য
বুম দেখে ছবিটি ফেসবুকে অন্তত ২০২১ সাল থেকে উপলব্ধ একটি ভিডিওর থেকে নেওয়া।



মূলধারার গণমাধ্যমগুলি (media outlets) একটি পুরনো ছবি বিভ্রান্তিকর ভাবে রিপোর্ট করে দাবি করেছে ছবিতে অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে পহেলগাঁওয়ে (Pahalgam) সাম্প্রতিক জঙ্গি হানায় (terror attack) জড়িত এক জঙ্গিকে (terrorist) দেখা যাচ্ছে।
এই বিভ্রান্তিকর রিপোর্টটি অন্যান্য সংবাদমাধ্যম ছাড়াও, বাংলায় রিপাব্লিক বাংলা তাদের নিউজ চ্যানেলে সম্প্রচার করে এবং আনন্দবাজার পত্রিকা ও আজকাল তাদের অনলাইন প্রতিবেদনে পুরনো ছবিটি জঙ্গি হানার এক্সক্লুসিভ ‘প্রথম দৃশ্য’ হিসাবে প্রকাশ করে।
বুম যাচাই করে দেখে ভাইরাল ছবিটি ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ফেসবুকে উপলব্ধ একটি ভিডিওর স্ক্রিনশট। উপরন্তু, উল্লিখিত গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে কোনও সরকারী কর্মকর্তার বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত নেই যা নিশ্চিত করে ছবিতে সাম্প্রতিক পহেলগাঁও হামলায় জড়িত একজন সন্ত্রাসবাদীকে দেখা যাচ্ছে।
ভারতীয়দের উপর একটি মারাত্মক হামলায়, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদীদের গুলিবর্ষণে পর্যটক এবং এক স্থানীয় বাসিন্দাসহ ২৬ জন প্রাণ হারায়। নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং হামলা থেকে বেঁচে ফেরা পর্যটকরা অভিযোগ করেছেন সন্ত্রাসবাদীরা পরিচয় এবং নাম জিজ্ঞাসা করে কেবল অমুসলিম পুরুষদের হত্যা করেছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, জঙ্গি হামলায় জড়িত পাঁচজন জঙ্গির মধ্যে তিনজন পাকিস্তানের ছিল। ভারত সরকারের এখনও অবধি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখা অন্যতম।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে হাতে রাইফেল নিয়ে বেগুনি রঙের কুর্তা-পায়জামা পরা এক ব্যক্তিকে এমন ভাবে দেখা যায় যেন ওই ব্যক্তির ছবি দৌড়ে পালানো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
রিপাবলিক বাংলা তাদের সরাসরি সম্প্রচারে দাবি করে, "পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় পর, জঙ্গির প্রথম ছবি রিপাবলিক বাংলায়।"
আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথমে সংশ্লিষ্ট ছবিটি প্রকাশ করলেও, পরবর্তীতে তাদের প্রতিবেদনের ছবি পালটে ভুল সংশোধন করে একটি নোট যোগ করে। সংবাদমাধ্যম আজকালও তাদের প্রতিবেদনে ছবিটি প্রকাশ করেছিল।

ইন্ডিয়া টুডে পহেলগাঁওয়ের উপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ক্যামেরায় ধরা পড়া একজন জঙ্গি হিসাবে ছবিটি সম্প্রচার করে দাবি করে, "পর্যটকদের উপর হামলা করা সন্ত্রাসবাদীদের একজনের প্রথম ছবি" বলে। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক আরও দাবি করেন ছবিটি ইন্ডিয়া টুডের এক্সক্লুসিভ গ্রাউন্ড রিপোর্টের। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
হিন্দি নিউজ চ্যানেল আজতকও ছবিটি প্রকাশ করে একই ভুয়ো দাবি করে বলে ছবিটি হামলার সময় উপস্থিত এক ব্যক্তির তোলা। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
এছাড়াও, টাইমস নাও, এবিপি নিউজ, জি নিউজ, দ্য ইকোনমিক টাইমস, নিউজ ১৮, সিএনবিসি টিভি ১৮, মিন্ট, ফার্স্টপোস্ট, রিপাবলিক এবং নিউজ ২৪ সহ আরও বেশ কয়েকটি আউটলেট একই ছবিসহ ভুল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
নিউজ১৮ এবং টাইমস নাও কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই তাদের প্রতিবেদনটি আপডেট করে ছবিটিকে খণ্ডন করে সেগুলিকে একটি তথ্য যাচাইয়ে পরিণত করেছে।
তথ্য যাচাই
বুম ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে একই দৃশ্য দেখতে পায় যা ইঙ্গিত করে ২২ এপ্রিল, ২০২৫-এর হামলার প্রায় চার বছর আগে থেকে ছবিটি উপলব্ধ।
আমরা প্রথমে ভিডিওটিকে কিফ্রেমে ভাগ করে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ইনস্টাগ্রামের সাম্প্রতিক একটি পোস্টে অন্য দিক থেকে তোলা ভাইরাল ছবির মতো একই দৃশ্য দেখতে পাই।
সাম্প্রতিক পোস্টটিতে একই ব্যক্তিকে একটি ভিন্ন দিক থেকে দেখা যায় যেখানে তার রাইফেলটি আরও স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান। এর থেকে বোঝা যায়, এই ছবিটি সম্ভবত একটি দীর্ঘতর ভিডিওর অংশ।
এর থেকে সূত্র নিয়ে, আমরা কিছু নির্দিষ্ট কিওয়ার্ড ব্যবহার করে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ২০২১ সালের অক্টোবরে ফেসবুকে আপলোড করা একটি ভিডিওতে উভয় ছবির দৃশ্যই দেখতে পাই।

পোস্টটি দেখুন এখানে এবং আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ভিডিওটি পোস্ট করা হয় একটি পাকিস্তানি অ্যাকাউন্ট থেকে তবে, ভিডিওটির ক্যাপশন থেকে লোকটির অবস্থান বা পরিচয় সম্পর্কে কোনও বিবরণ জানা যায় না।
৪০ সেকেন্ডের ফুটেজে, লোকটিকে তার রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ/অস্ত্র প্রশিক্ষণের মতো বিভিন্ন কৌশল করতে দেখা যায়। ভিডিওটিতে আরেকজন ব্যক্তিকে লোকটির কাছ থেকে সামান্য দুরত্বে দাঁড়িয়ে তার প্রশিক্ষণ দেখতে দেখা যায়।
নীচে নিউজ চ্যানেলগুলির সম্প্রচারিত ছবির সঙ্গে ফেসবুকে উপলব্ধ ভিডিওর মধ্যে একটি তুলনা দেখা যাবে।

দুটি এক্স হ্যান্ডেলও ২০২১ সালের ওই ভিডিওর সাহায্যে ছবিটি খণ্ডন করে। দেখুন এখানে এবং এখানে।
উপরন্তু, পহেলগাঁও হামলা থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তিরা তাদের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতিতে বলেছেন আক্রমণকারীরা জলপাই পোশাক পরেছিল যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের সঙ্গে মেলে না। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা কয়েকজন পর্যটককে ঘিরে ফেলে, মহিলা ও শিশুদের সরে যেতে বলে এবং তারপর তাদের খুব কাছ থেকে গুলি করে। অন্যান্য প্রতিবেদনে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এবং জঙ্গিরা ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে পরিচয় জেনে তারপর গুলি করে হত্যা করে।
ভিডিওতে লোকটিকে নানা রকম ভঙ্গি করে কেবল বাতাসে তার বন্দুক নির্দেশ করতে দেখা যায়,তিনি কাউকে আক্রমণ করেন না বা তার রাইফেল দিয়ে গুলিও করেন না। ভিডিওর প্রেক্ষাপটে কোনও ভুক্তভোগীকে দেখা যায় এবং পহেলগাঁওয়ে হামলার দৃশ্যের সঙ্গেও মেলেনা যেমনটা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের সাক্ষাৎকারে বর্ণনা করেছেন।
বুম স্বাধীনভাবে লোকটির অবস্থান বা পরিচয় যাচাই করতে সক্ষম হয়নি তবে গণমাধ্যমগুলির দ্বারা প্রকাশিত আক্রমণকারীর ছবি যে পুরানো এবং সাম্প্রতিক পহলগাম হামলার নয় তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।