এই ব্যক্তি কি ইউক্রেনে যুদ্ধে যাওয়ার আগে মেয়েকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে?
আমরা দেখি ভিডিওটি ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলে তোলা। ওই পরিবার ইউক্রেন ছেড়ে রাশিয়ায় চলে যাচ্ছে।
সোশাল মিডিয়ায় একটি আবেগঘন মুহূর্তের (Emotional Moment) ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাতে এক ব্যক্তিকে অশ্রুসজল চোখে তার মেয়েকে বিদায় জানাতে দেখা যাচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, ওই লোকটি একজন ইউক্রেনীয়, যে রাশিয়ার (Russia) আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশরক্ষার লড়াইয়ে যোগ দিতে যাচ্ছে। মূল ধারার অনেক ভারতীয় সংবাদ-মাধ্যমও তাদের সংবাদ-চ্যানেলে একই দাবি সহ ভিডিওটি প্রচার করেছে।
কিন্তু বুম দেখে দাবিটি বিভ্রান্তিকর এবং আমারা অনুসন্ধান করে জানলাম ভিডিওটি বিচ্ছিন্নতাকামী ডনেস্টস্ক গণপ্রজাতন্ত্রের গোরলোভকা অঞ্চলের যারা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আমরা দেখলাম, ওই ব্যক্তিটি যুদ্ধ-কবলিত ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তায় তার পরিবারকে সরিয়ে নিয়ে যেতে উদগ্রীব।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চলতি সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটেই এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এই সংঘর্ষময় পরিস্থিতি নানা রকম ভুয়ো খবর ও ভুল তথ্যের জন্ম দিয়ে চলেছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে তার বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকেই এই ভিডিওটি ফেসবুক ও টুইটারে ভাইরাল হতে শুরু করে। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তি তার ছোট্ট মেয়েকে বিদায় জানাতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছে আর তার পরেই এক মহিলা এসে মেয়ে ও তার বাবা দুইজনকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
এই রকম একটি ভিডিও টুইটারে শেয়ার করা হয়েছে তুর্কি ভাষায়, যাতে বলা হচ্ছে, "এ ভাবেই ইউক্রেনের এক পিতা তাঁর পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর আগে কন্যাকে বিদায় জানাচ্ছেন।"
এই প্রতিবেদন রচনার সময় পর্যন্ত এই ভিডিওটি ২ কোটি লোক দেখে ফেলেছেন। ভিডিওটির আর্কাইভ বয়ান দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
'মেয়েকে বাবা বিদায় জানাচ্ছে'—এই শব্দগুলি বসিয়ে আমরা ফেসবুকে খোঁজ করে দেখি, সেখানেও একই ক্যাপশন সহ এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।
তাদের মধ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জি-নিউজ, রিপাবলিক টিভি, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টাইমস এবং ওয়ান ইন্ডিয়ার মতো সংস্থার যাচাই-করা পেজগুলিও রয়েছে।
আরও পড়ুন: পুণ্যার্থীর খাদ্য বিতরণের পুরনো ছবি ইউক্রেনে ইসকনের জনসেবা বলে ভাইরাল
তথ্য যাচাই
বুম ভিডিওটিকে কয়েকটি মূল ফ্রেমে ভেঙে নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, অজস্র এমন পোস্ট ছড়িয়েছে, যাতে ওই ব্যক্তিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্যত পিতা হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে।
আমরা ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলার আগে এই ভিডিও কোথাও পোস্ট হয়েছে কিনা জানতে চেষ্টা করি এবং দেখি, রুশ হানাদারির তিন দিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখেই টুইটারে এই ভিডিওটি আত্মপ্রকাশ করেছিল।
এই ভিডিওটির সঙ্গে রুশ ভাষায় ক্যাপশন দেওয়া হয়েছিল, "গোরলোভকা থেকে চলে যাওয়া—একটি হৃদয়বিদারক ফুটেজ...।"
গোরলোভকা কিংবা হরলিভকা নামে পরিচিত এই নগরীটি ইউক্রেনের ডনেস্টস্ক ওবলাস্ট অঞ্চলে অবস্থিত, যেটি ২০১৪ সালের বিক্ষোভের পর থেকেই রুশ-নিয়ন্ত্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তা ছাড়া, ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ডনেস্টস্ক ও লুহান্স্ক অঞ্চলগুলিকে স্বাধীন ভূখণ্ড বলে স্বীকৃতি দেন।
টুইটটির সূত্র অনুসরণ করে আমরা রুশ সোশাল মিডিয়া ওয়েবসাইট ভিকে-তে খোঁজ-খবর করেও একই ভিডিও দেখতে পাই, রুশ ভাষায় লেখা যার বিবরণ অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "চোখের জলে বিদায় জানানোর এক মর্মস্পর্শী মুহূর্ত, যখন গৃহকর্তা তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিরাপত্তার খোঁজে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ইউক্রেনের সরকার ডনবাস-এর অসামরিক নাগরিকদের উপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, তার পরিণামে ডনবাস প্রজাতন্ত্রের সাধারণ মানুষদের দুর্গতির শেষ নেই। প্রায় প্রতিদিনই তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবারের প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে হচ্ছে। এই ভিডিওতে আমরা যে গৃহকর্তাকে দেখছি, স্ত্রী ও মেয়েকে নিরাপদে রাশিয়ায় পাঠিয়ে তিনি নিজে থেকে যাচ্ছেন লড়াই করতে। তাঁর হাতে প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার আগ্নেয়াস্ত্র, কিন্তু চোখে জল।"
এই ভিডিওটি শেয়ার হওয়ার কিছু দিন আগেই রুশ-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডনেস্ক ও লুহানস্ক থেকে রাশিয়ায় পরিবারের লোকেদের পাঠিয়ে দিতে শুরু করে যাতে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগেই তারা নিরাপত্তায় পৌঁছে যায়।
এর আগে মালদিতা এই ভিডিওটির তথ্য-যাচাই করেছে।
আরও পড়ুন: ২০২০ সালে লেবাননে বিস্ফোরণের ভিডিও ছড়াল ইউক্রেনের কিয়েভে বিস্ফোরণ বলে