ভারতে গোহত্যা বন্ধের দাবিতে উরুগুয়ের তুলনা করা বার্তাটি বিভ্রান্তিকর
ভাইরাল বার্তায় উরুগুয়ের গোমাংস রফতানির প্রসঙ্গ তুলে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে সেখানে গোহত্যার জন্য প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়।
একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে ভারতে গোহত্যা (Cow salughter) বন্ধ করার পক্ষে সওয়াল করে উরুগুয়ের (Uruguay) গোপালন-শিল্প ও আইনের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। বার্তাটি বিভ্রান্তিকর।
উরুগুয়ে প্রতি বছর কত পরিমাণ গোমাংস রফতানি করে ওই মেসেজে তার উল্লেখ নেই, বরং মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, সে দেশে গোহত্যা করলে প্রাণদণ্ড (capital punishment) দেওয়া হয়।
ওই মেসেজে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিকে প্রায় স্বপ্নরাজ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে, পশু নিরাপত্তা, আইন ও কৃষি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভারতেরও উচিত উরুগুয়েকে অনুসরণ করা।
মেসেজটি নীচে দেখতে পাবেন।
বুম এই মেসেজটি তার হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরে (+৯১৭৭০০৯০৬৫৮৮) পায়। মেসেজটি সোশাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়েছে।
আরও পড়ুন:
তথ্য যাচাই
ভাইরাল হওয়া মেসেজে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে, উরুগুয়েতে গোহত্যার অপরাধে 'সঙ্গে সঙ্গে প্রাণদণ্ড' দেওয়া হয়। কিন্তু আসলে উরুগুয়েতে ১৯০৭ সাল থেকেই প্রাণদণ্ড কার্যত বিলুপ্ত হয়েছে।
তা ছাড়া উরুগুয়েতে গোমাংস রফতানির করার যে বিপুল শিল্প রয়েছে, তা ওই মেসেজে উল্লেখই করা হয়নি। গোহত্যা সেখানে অপরাধ বলেও গণ্য হয় না। মেসেজে আরও বলা হয়েছে যে, উরুগুয়ের গরু আসলে ভারত থেকেই গেছে।
মেসেজে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, উরুগুয়ের কৃষকরা 'লক্ষ লক্ষ' টাকা রোজগার করেন। কিন্তু এই বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনও তথ্য নেই। ওই দেশের নাগরিকদের রোজগার ডলারের হিসাবে অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।। প্রকৃত তথ্য বলছে যে, সে দেশের নাগরিকদের রোজগার অনেক কম।
তবে মেসেজে উরুগুয়ের খাদ্য উৎপাদন এবং দেশে গবাদি পশুর যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ।
নীচে ওই মেসেজের দাবিগুলির বিস্তারিত তথ্যযাচাই করা হল।
১। প্রত্যেক ব্যক্তির ৪টি করে গরু রয়েছে, এবং ৩৩ লক্ষ মানুষের দেশে গরুর সংখ্য ১.২ কোটি
এই দাবিটি আংশিক ভাবে সত্যি, কারণ মেসেজে বলা হয়েছে যে, এই পরিসংখ্যান ২০০৫ সালের। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন-এর ফাওস্ট্যাট-এ নথিভুক্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে, ২০০৫ সালে উরুগুয়ের জনসংখ্যা ছিল ৩,৩২১,৮০৩ (৩৩.২১ লাখ)। তা ছাড়াও, ২০০৫ সালে সে দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল ৮,৩৬৯,২০০ (৮৩.৬৯ লক্ষ), অর্থাৎ ২০০৫ সালে জনপ্রতি পালিত পশুর সংখ্যা ছিল। ২.৫১ (মোট পশুর সংখ্যাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায়)।
এফএও উল্লেখ করেছে যে, গবাদি পশুর এই পরিসংখ্যানের মধ্যে গরু, ষাঁড় ও বলদ, এবং বাছুরের সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেকের আড়াইখানা করে গরু রয়েছে।
যাই হোক, সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুসারে সে দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষের কাছাকাছি। দেশের জনসংখ্যা ৩০ লক্ষ, ফলে গড়ে প্রত্যেকের কাছে ৪টি করে গরু রয়েছে।
২। প্রতিটি গরুর কানে একটি ইলেক্ট্রনিক চিপ লাগানো রয়েছে, যা দিয়ে গরুগুলিকে ট্র্যাক করা যায়। ৩৩ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ ২ কোটি ৮০ লক্ষের জন্য উপাদন করে।
এই দাবিটি সত্যি।
২০১৪ সালের একটি রিপোর্টে উরুগুয়ের গবাদি পশুর ট্র্যাকিং সিস্টেমের উল্লেখ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সব গবাদি পশুকে ট্যাগ ও ট্র্যাক করা হয়। দুই কানে দুই ধরনের চিপ লাগানো হয়। একটি নাম্বার ট্যাগ ও অন্যটিতে ওই পশুর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেওয়া থাকে।
অর্থাৎ, সে দেশে গবাদি পশুর মাংসকে তার জোগান শৃঙ্খলের প্রতিটি পর্যায়ে ট্র্যাক করা সম্ভব— কোথায় পশুটি পালিত হয়েছে থেকে কোন দোকানে সেই মাংস পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি বিদেশেও কোথায় যাচ্ছে, তা জানা সম্ভব।
ওই রিপোর্টে আর উল্লেখ করা হয় যে, মাংস কোথা থেকে আসছে, তা জানা ক্রেতার অধিকার।
আরও পড়ুন: এই ভাইরাল ছবিটি হাসপাতালের বেডে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নন
উরুগুয়ের কৃষি মন্ত্রী কার্লোস মারিয়া উরিয়ার্তে ব্রাজিলের টিভি চ্যানেল এগ্রোমায়াসে মন্তব্য করেন যে, পরিবেশের সুস্থিতি বজায় রেখেও উরুগুয়ের কৃষিপণ্য রফতানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, "পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে আরও উৎপাদন বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, কারণ আগামী দিনে পৃথিবীতে আরও খাদ্যের প্রয়োজন হবে। উরুগুয়ের জনসংখ্যা ৩০ লক্ষ, আর আমরা উৎপাদন করি তিন কোটি লোকের জন্য। আমরা এর দ্বিগুণ উৎপাদন করতে পারি। আমরা জানি যে, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আমাদের আরও চাপ দিতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা এটাও জানি যে, মাটির স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতার ক্ষতি না করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।"
এটি কৃষির একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা ইন্টার-আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর কোঅপারেশন অন এগ্রিকালচার-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। প্রতিবেদনটি পড়তে পারেন এখানে।
৩। একজন ব্যক্তির রোজগার প্রতি মাসে কমপক্ষে ১,২৫, ০০০ টাকা, অর্থাৎ বছরে ১,৯০,০০ ডলার
এই মেসেজে স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, মাথাপিছু যে রোজগারের কথা বলা হয়েছে, তা দেশের গড় আয়, না কি শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কথা বলা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বিষয়ক পোর্টাল স্ট্যাটিস্টার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার বেশির ভাগ দেশের তুলনায় উরুগুয়েতে ন্যূনতম মজুরির হার বেশি। ২০২১ সালে এই মজুরির হার প্রতি মাসে ৪২৩ ডলার। অর্থাৎ, কোনও এক ব্যক্তি ন্যূনতম মজুরি উপার্জন করলে বছরে তাঁর আয়ের অঙ্কটি দাঁড়ায় ৫০৭৬ ডলার। কিন্তু, এই পরিসংখ্যানটি জানানোর পাশাপাশি একটি নোটে বলা হয়েছে যে, কী ভাবে এই পরিসংখ্যান পাঠ করতে হবে।
অন্য দেশের তুলনায় উরুগুয়ের ন্যূনতম মজুরির হার বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই নোটটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ন্যূনতম মজুরি যথেষ্ট নয়। দেখুন এখানে।
স্ট্যাটিস্টায় আরও পরিসংখ্যান দেখতে পারেন।
২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উরুগুয়েতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮,৬৯০ ডলার ও ১৮,৭০৩ ডলার ছিল। এই হিসেবগুলি নমিনাল বা মুদ্রার অঙ্কে: সংশ্লিষ্ট বছরগুলিতে দেশে মূল্যস্তর কী ছিল, এই অঙ্ক থেকে তার আন্দাজ পাওয়া যায়। ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১৫,৪৩৮ ডলার। অন্য একটি হিসেব অনুসারে, ২০১৫ সালের মার্কিন ডলারের ধ্রুবক মূল্যে, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ১৬,০২০ ডলার, ১৬,০৩৭ ডলার, ১৬,০৩৬ ডলার এবং ১৫,০৪৪ ডলার। তবে, বর্তমান মার্কিন ডলারের বদলে ২০১৫ সালকে ভিত্তিবছর ধরে ধ্রুবক ডলারের হারে হিসেব করলে তাতে সংশ্লিষ্ট বছরের মূল্যস্তর প্রতিফলিত হয় না।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে এই পরিসংখ্যান দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
'উরুগুয়ের কৃষকরা লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করেন', এমন দাবি করার মতো কোনও প্রমাণ নেই।
৪. গোহত্যা করলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড
এই দাবিটি ভুয়ো। গোহত্যার জন্য সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের কোনও ব্যবস্থা নেই।
১৯০৭ সাল থেকেই উরুগুয়েতে কোনও অপরাধের জন্যই প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় না। ইন্ডিয়ান ল কমিশনের রিপোর্টে (পৃষ্ঠা ১২) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো অসরকারি সংস্থার নথি থেকে এই তথ্যটি যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।
তা ছাড়াও, উরুগুয়েতে গোহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, এবং সেই দেশে যথেষ্ট পরিমাণ গোমাংস খাওয়া হয় ও রফতানি করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)-র ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিসেস-এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, ২০২০-র জানুয়ারি থেকে ২০২১-এর জানুয়ারি অবধি মোট ১১ লক্ষ হেড (গবাদি পশুর এক একককে বলা হয় হেড) জবাই করা হয়েছে, এবং তার পরের বছরে সংখ্যাটি ১১.৮ লক্ষে পৌঁছবে বলে অনুমান। তা ছাড়াও, ইউএসডিএ-র পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছএ যে উরুগুয়ে মোট ৪১২,০০০ টনের সমতুল কারকাস ওয়েট ইকুইভ্যালেন্ট (সিডব্লিউই) (আংশিক ভাবে জবাই করা মাংসের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে যে কথাটি বলা হয়ে থাকে, যদিও শুয়োর, গবাদি পশু, ভেড়া ইত্যাদি উৎসের উপরই মূলত নির্ভরশীল) মাংস রফতানি করা হয়েছে। অনুমান, আগামী বছর এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪৯০,০০০ টন।
বস্তুত, একটি সমীক্ষা উরুগুয়েকে বিশ্বের নবম বৃহত্তম গোমাংস রফতানিকারক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এবং জানিয়েছে যে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট গোমাংস রফতানির ৪% করেছিল এই দেশ।
আরও পড়ুন: রামায়ণের 'সুগ্রীব'-এর নামে ইন্দোনেশিয়ায় দীনপাসার হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়?