চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারকে যুদ্ধে হারান, আদিত্যনাথের দাবি কি ঠিক?
ইতিহাসবিদদের মতামত ও ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে আলেকজান্ডারের দর্শন সম্ভব হলেও তা যুদ্ধক্ষেত্রে হয়নি।
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তকে (Chandragupta) ইতিহাসবিদরা 'গ্রেট' বা মহান বলেন না, যদিও তিনি গ্রিক রাজা আলেকজান্ডারকে (Alexander) যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। এই দাবি করে, উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (Yogi Adityanath) বিতর্কের ঝড় তুলেছেন।
১৪ নভেম্বর, বিজেপির ওবিসি মোর্চার এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে, আদিত্যনাথ বলেন, "ইতিহাস কখনও সম্রাট অশোক বা চন্দ্রগুপ্তকে গ্রেট আখ্যা দেয়নি। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তর কাছে পরাজিত হলেও, আলেকজান্ডারকে গ্রেট বলা হয়। এই ধরনের বিষয়ে ইতিহাসবিদরা চুপ। তবে দেশবাসী যেদিন সত্যটা জানতে পারবেন, সেদিন ভারত পাল্টে যা্বে।"
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ হাইদাসপাস'র যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত। সেখানে রাজা পুরু'র সঙ্গে যুদ্ধ হয়। জায়গাটি এখন পাকিস্তানে। যুদ্ধে জিতলেও, গ্রিকদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। আলেকজান্ডার, পূর্বে অবস্থিত গাঙ্গেয় সমতলভূমির দিকে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর রণক্লান্ত সেনারা দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলেন।
বুম ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে এবং ঐতিহাসিক নথি ঘেঁটে জেনেছে যে, চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে আলেকজান্ডারের দেখা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু দু'জনের সাক্ষাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে কখনওই হয়নি। যদিও তেমনটাই দাবি করেছেন যোগী আদিত্যনাথ।
আরও পড়ুন: রামায়ণের 'সুগ্রীব'-এর নামে ইন্দোনেশিয়ায় দীনপাসার হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়?
আলেকজান্ডার ও চন্দ্রগুপ্ত কি যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়েছিলেন?
১৯২৩ সালে, ইতিহাসবিদ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির বই 'পোলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ এনসেন্ট ইন্ডিয়া: ফ্রম দ্য অ্যাকসেশন অফ পরীক্ষিত টু দ্য এক্সটিঙ্কশন অফ দ্য গুপ্ত ডাইনেস্টি' প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেন যে, আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় আলেকজান্ডারের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তর দেখা হয়েছিল, এমন নথি আছে।
হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি বলেছেন যে, গ্রিক ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক ও ল্যাটিন ইতিহাসবিদ জাস্টিন লেখেন যে, চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেন। এবং তাঁকে তাঁর অভিযান অব্যাহত রেখে নন্দ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানোর আর্জি জানান।
পোলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ এনসেন্ট ইন্ডিয়া'র প্রথম সংস্করণের ১৩৯ পাতায়, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি লেখন, "প্লুটার্ক বলছেন (লাইফ অফ আলেকজান্ডার, LXI), 'অ্যান্ড্রোকোট্টাস নিজে যখন বালক ছিলেন, তখন তিনি স্বয়ং আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেন। এবং তিনি পরে বলেন যে, আলেকজান্ডার অনায়াসেই সারা দেশ জয় করতে পারতেন। কারণ, সেই সময়কার রাজা নীচ ও ক্রুর প্রকৃতির হওয়ায়, প্রজারা তাঁকে ঘৃণা করতেন।' এই বিবরণ থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, মগধের অত্যাচারী রাজার শাসনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্ত বিজয়ী আলেকজান্ডারকে অভিযান চালিয়ে যাওয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।"
অ্যান্ড্রোকোট্টাস হল চন্দ্রগুপ্তর ল্যাটিন নাম, ও স্যান্ড্রোকোট্টাস হল তার গ্রিক নাম।
তবে আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্তকে পছন্দ করেননি। এবং ওই ভবিষ্যৎ রাজাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন।
হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি আরও লেখেন: "আপাতদৃষ্টিতে চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারকে আগ্রাম্মেস'র মতোই অত্যাচারী মনে করেছিলেন। কারণ, আমরা জাস্টিন'র কাছ থেকে জানতে পারি যে, তার বলিষ্ঠ ভাষার জন্য ওই সাহসী ভারতীয় বালককে মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাসিডনিয়ার রাজা বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি। ম্যাসিডনীয় ও ভারতীয়, দুই অত্যাচারীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা ভেবে ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। কৌটিল্য, যিনি চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত, তাঁর সাহায্যে কুখ্যাত নন্দকে উৎখাত করেন।" (পোলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ এনসেন্ট ইন্ডিয়া'র প্রথম সংস্করণ, পাতা-১৩০)। আগ্রম্মেস সম্ভবত শেষ নন্দ রাজা ধন নন্দ'র গ্রিক নাম।
অশোকা ইউনিভারসিটির ইতিহাসের প্রফেসর ড. নয়নজ্যোত লাহিড়ী, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির সঙ্গে একমত। ড. লাহিড়ী প্রাচীন ভারতের ওপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তার মধ্যে আছে 'অশোকা ইন এনসেন্ট ইন্ডিয়া'। উনি বুমকে বলেন যে, চন্দ্রগুপ্ত যখন ছোট ছিলেন, তখন দুই রাজার দেখা হয়েছিল। কিন্তু তা যুদ্ধক্ষেত্রে নয়।
"প্লুটার্ক আমাদের জানিয়েছেন যে, খুব কম বয়সে চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেন। কিছু সূত্রের কথা অনুযায়ী, চন্দ্রগুপ্ত তক্ষশীলায় পড়াশোনা করেছিলেন। এবং আলেকজান্ডার সেখানে গিয়ে ছিলেন। মনে করা হয়, সেখানেই তাঁদের দেখা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনা, আর চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারকে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন বলা, সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার," বলেন ড. লাহিড়ী। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি লিখেছেন যে, খৃস্টপূর্ব ৩২৫-এ আলেকজান্ডার ফিরে গেলে, চন্দ্রগুপ্ত শেষ নন্দ রাজা ধন নন্দকে উৎখাত করে পাটলিপুত্র দখল করে নেন। তারপর উনি উত্তর-পশ্চিমের যে সব জায়গা গ্রিকরা দখল করেছিল, সেগুলির দিকে নজর দেন ও সেগুলিকে নিজের শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। (পোলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ এনসেন্ট ইন্ডিয়া'র প্রথম সংস্করণ, পাতা-১৪০)।
যদিও চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের মুখোমুখী হননি, কিন্তু সেলুকাস ১ নিকেটার নামের আরও এক গ্রিক রাজার মুখোমুখী হয়েছিলেন। তবে চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে সে যুদ্ধ শেষ হয়।
সেলুকাস ছিলেন আলেকজান্ডারের একজন সেনাপতি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ এ, আলেকজান্ডারের অকাল মৃত্যু হলে, সেলুকাস ম্যাসিডনিয়ার বিরাট সাম্রাজ্য নিজের অধীনে আনার চেষ্টা করেন।
হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি লিখেছেন যে, গ্রিক ইতিহাসবিদ আলেকজান্ড্রিয়ার আপ্পিয়ান, স্ট্রাবো এবং প্লুটার্ক ও জাস্টিন'র কথা অনুযায়ী, ব্যাবিলন দখল করার পর, সেলুকাস ভারত আক্রমণ করেন। মৌর্য সাম্রাজ্য থেকে এলাকা পুনর্দখল করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
"অ্যাপ্পানিয়াস'র কথা অনুযায়ী (ইন্ড. অ্যান্ট. ভল. ভি১, পি.১৪৪), উনি সিন্ধু নদ পেরিয়ে, ভারতীয়দের রাজা চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে যুদ্ধ করেন, যতক্ষণ না তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন হয় ও সেলুকাস বৈবাহিক সস্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। জাস্টিন জানিয়েছেন যে, চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন করে পূর্ব দিকের সব কিছুর সামাধান করে, সেলুকাস অ্যান্টিগনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলে যান। প্লুটার্কের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০ হাতি উপহার দিয়েছিলে," লিখেছেন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি।(পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অফ এনসেন্ট ইন্ডিয়া'র প্রথম সংস্করণ, পাতা-১৪১)।
স্ট্রাবো তাঁর জিওগ্রাফিকা'য় লিখেছেন {Insert link: https://penelope.uchicago.edu/Thayer/E/Roman/Texts/Strabo/15B*.html#2.9] , "তাদের দিক থেকে, ভারতীয়রা সিন্ধু নদের পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা দখল করে নেয়। সেগুলি আগে পারস্যদের অধীনে ছিল। আলেকজান্ডার সেই সব জায়গা এরিয়ানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে তাঁর নিজের বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু আন্তবিবাহের ফলে ও চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে ৫০০ হাতি দেওয়ায়, সেলুকাস নিকাটর ওই জায়গাগুলি স্যান্ড্রাকোট্টাসকে দিয়ে দেন।(জিওগ্রাফিকা, বই ১৫, পরিচ্ছেদ ২, পাতা-১৪৫)।
'গ্রেটনেস' বা মাহাত্ব সংক্রান্ত বিতর্ক
তাঁর ভাষণে, আদিত্যনাথ এও দাবি করেন যে, ইতিহাসবিদরা ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্তকে 'গ্রেট' (মহান) মনে করেন না। কিন্তু আলেকজান্ডারের ক্ষেত্রে ওই উপাধি ব্যবহার করেন।
আলেকজান্ডারকে 'গ্রেট' আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে আদিত্যনাথের আপত্তির সঙ্গে ড. লাহিড়ী একমত। কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা কারণে।
"আলেকজান্ডার গ্রেট নন। কিন্তু আদিত্যনাথ যে কারণে তাঁকে গ্রেট মনে করেন না, সেই কারণে নয়। ওনাকে 'গ্রেট' বলা হয় কারণ উনি সব যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তার ফলে, যা ঢাকা পড়ে যায় তা হল তাঁর নৃশংসতা এবং যেভাবে তিনি মানুষকে পিটিয়ে তাদের বশ্যতা আদায় করেন। সিন্ধু উপত্যকার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়, তিনি একাধিক শহর গুঁড়িয়ে দেন। হাজারে হাজারে মানুষ হত্যা করেন। তাঁকে গ্রেট বলার মধ্য দিয়ে, পারস্য থেকে ভারত পর্যন্ত তাঁর ওই হত্যালীলা ও সংঘঠিত গণহত্যার বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়," উনি বলেন।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিস্টরিক্যাল স্টাডিজ-এর প্রাক্তন প্রফেসর নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য বলেন, 'গ্রেট' বলার অভ্যাসটা উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস লেখার ঐতিহ্যের অবশেষ। এখন আর তার চল নেই।
"কোনও এক ব্যক্তিকে গ্রেট বলার চলন ছিল উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস লেখার ঐতিহ্যে। তখন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে একটা রায় দেওয়া হত। তাঁদের সাফল্য ও ব্যর্থতার নিরিখে তাঁর মাহাত্ব বিচার করা হত। কিন্ত ১৯৭০'র পর থেকে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই আর ওই ভাবে কোনও রায় দেন না," বলেন প্রফেসর ভট্টাচার্য্য।
"ইতিহাসবিদরা দেখেন যে, একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব (রাজা, নেতা, বিদ্রোহী, চিন্তাবিদ) কী ভেবেছেন ও কী করেছেন।কী ভাবে তিনি তার সমকালীন বিষয় ও সমস্যার মোকাবিলা করেছেন। তাঁর পদক্ষেপগুলি অন্যের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে। এবং তাঁর সময়ে মানুষজন তাঁকে কী ভাবে দেখেছে।
"তাই, যে সব ইতিহাসবিদ আজকের দিনের ইতিহাস লেখার প্রথা মেনে চলেন, তাঁরা কেউই চন্দ্রগুপ্ত বা আলেকজান্ডারকে 'গ্রেট' আখ্যা দেবেন না। তাঁদের সময়কে বোঝার জন্য তাঁদের কার্যকলাপই বিশ্লেষণ করা হবে," বলেন প্রফেসর ভট্টাচার্য্য।
আরও পড়ুন: না, কঙ্গনা রানাউতের পদ্মশ্রী বাতিলের পরামর্শ দেননি রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ