
বিকাশ দুবে: ওৎ পেতে ধরা থেকে এনকাউন্টারে নিধন পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা
উজ্জয়িনীতে গ্রেফতার হওয়ার একদিন পরেই ১০ জুলাই পুলিশের এনকাউন্টারে নিহত হলো কুখ্যাত মাফিয়া বিকাশ দুবে।

কুখ্যাত দুষ্কৃতী বিকাশ দুবের গ্রেফতারি নিয়ে নাটকীয় সব ঘটনার অবসান হল ১০ জুলাই, যখন উত্তরপ্রদেশের পুলিশ দুবেকে কথিত এনকাউন্টারে হত্যা করল। গত ৩ জুলাই কানপুরে এক অতর্কিত হামলায় ৮ জন পুলিশকে হত্যা করার পর থেকেই বিকাশ দুবে ফেরার ছিল। কানপুরের বিক্রু গ্রাম ছিল বিকাশের ঘাঁটি। বিকাশের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় রয়েছে ৫টি খুনের মামলা সহ মোট ৬২টি অপরাধের অপরাধের অভিযোগ। ৯ জুলাই উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে তাকে দেখতে পাওয়ার পরই বিকাশকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের আগে পর্যন্ত ঘটনাবলী:
অতর্কিত হামলা
খুনের চেষ্টার অভিযোগে বিকাশ দুবেকে গ্রেফতার করতে আসা এক পুলিশ দলের ৮ জন সদস্যকে ৩ জুলাই বিকাশ দুবে অতর্কিতে হামলা করে হত্যা করে। নিহত ৮ জনের মধ্যে ছিলেন একজন ডেপুটি পুলিশ সুপার দেবেন্দ্রকুমার মিশ্র, সাব-ইনস্পেক্টর মহেশচন্দ্র যাদব, অনুপ কুমার সিং ও নেবুলাল এবং কনস্টেবল জিতেন্দ্র পাল, সুলতান সিং, বাবলু কুমার ও রাহুল কুমার।
উত্তরপ্রদেশের ডিজিপি হিতেশ চন্দ্র আবাস্থি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "ওই দিন মধ্যরাতে ২০ জন পুলিশের একটি দল বিকাশকে পাকড়াও করতে চৌবেপুর পৌঁছলে মাঝরাস্তায় তাদের পথ আটকে দেয় একটি জেসিবি মেশিন। পুলিশরা যেই না তাদের গাড়ি থেকে নেমেছে, অমনি বিকাশের দলবল তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। আমাদের দিক থেকেও জবাবি গুলি ছোঁড়া হয়, কিন্তু ওরা যেহেতু অন্ধকারে আত্মগোপন করেছিল এবং খানিকটা উঁচু স্থান থেকে গুলি চালাচ্ছিল, তাই আমাদের লোকেরা বেশি গুলি খায়। আটজন পুলিশ তো ওদের গুলি খেয়েই মারা গেছে।"
পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে দুবের দুই সাগরেদকে হত্যা করে এবং তাদের কাছ থেকে একটি রিভলভার ও একটি দেশি পিস্তলও উদ্ধার করে। কিন্তু বিকাশকে পুলিশ সে দিন ধরতে পারেনি।
পরবর্তী ঘটনাক্রম
বিকাশের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরের দিনই উত্তরপ্রদেশ পুলিশ চৌবেপুর থানার স্টেশন অফিসার বিনয় তেওয়ারিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে এই যুক্তিতে যে, বিনয়ই বিকাশ দুবের দলকে পুলিশি অভিযানের গোপন খবর আগাম জানিয়ে দিয়েছিল। বিকাশের বাড়িটাও পুলিশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এবং ওর সব কটি গাড়িই ধ্বংস করে দেয়।
Kanpur: House of the history-sheeter Vikas Dubey, the main accused in Kanpur encounter case, being demolished by district administration. More details awaited.
— ANI UP (@ANINewsUP) July 4, 2020
8 policemen were killed in the encounter which broke out when police went to arrest him in Bikaru, Kanpur yesterday. pic.twitter.com/gukyZZwfl9
৫ জুলাই এক অভিযান চালিয়ে পুলিশ বিকাশের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী দয়াশংকর অগ্নিহোত্রীকে আটক করে ফেলে। অগ্নিহোত্রীকে আটক করার সময়ে তাঁর পায়ে গুলি করা হয়েছিল, তাই সে পালাতে পারেনি। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অগ্নিহোত্রী এক সাংবাদিককে জানায়, দুবে থানা থেকেই ফোনে আসন্ন পুলিশি অভিযানের কথা আগাম জানতে পেরে গিয়েছিল, আর তাই ওর পক্ষে অতর্কিত হামলার ছক তৈরি করা সহজ হয়। এর পরেই দুবেকে ধরিয়ে দিতে পারলে সরকার এক লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে।
#Kanpur: Police arrests gangster Vikas Dubey's aide Daya Shankar Agnihotri in encounter. Says Dubey was informed about the raid, got a call from Chaubeypur Police Station pic.twitter.com/pG90JbWL05
— Mojo Story (@themojo_in) July 5, 2020
পুলিশি তৎপরতার খবর আগাম দুবের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়ে ৬ জুলাই আরও ৩ জন পুলিশকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর পুলিশ দুবেকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কারের অঙ্ক আড়াই গুণ বাড়িয়ে দেয়। ৮ জুলাই পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টর তেওয়ারি এবং কে কে সিংকে গ্রেফতার করে দুবেকে সব খবর আগাম জানিয়ে দেওয়ার দায়ে। শুধু তাই নয়, চৌবেপুর থানায় যে ৬৮ জন পুলিশ নিয়ুক্ত ছিল, তাদের সকলকেই পুলিশ লাইনে বদলি করে দেওয়া হয়।
কানপুরের পুলিশ প্রধান দীনেশ কুমার এনডিটিভি-কে জানান, "আমরা অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করার পরই গ্রেফতারি শুরু করি। যদি কেউ পুলিশকে তার কাজ করতে বাধা দেয় কিংবা এমন ষড়যন্ত্র করে যাতে পুলিশের ক্ষতি হয়, তাহলে সে নিজে পুলিশ হলেও ছাড় পাবে না।"
উত্তরপ্রদেশ সরকার এরপর ডিআইজি অনন্ত দেও-কেও সরিয়ে দেয়, যখন জানা যায় যে নিহত ডিএসপি দেবেন্দ্র মিশ্র গত মার্চ মাসেই বিনয় তেওয়ারির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে অনন্ত দেওকে চিঠি দিয়েছিলেন। সে সময় অনন্ত দেও ছিলেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের ডিআইজি। দেবেন্দ্র শর্মা তেওয়ারির নামে অভিযোগ করেছিলেন যে, এই লোকটি বিকাশ দুবের বিরুদ্ধে আনা একটি মামলার অভিযোগ লঘু করে দিয়েছে। অনন্ত দেও-কে এখন মোরাদাবাদের প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্ট্যাবুলেরিতে (পিএসি) বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
ইত্যবসরে দুষ্কৃতী-শিরোমণি দুবে একের পর এক পুলিশি চেকপোস্টের ফাঁক গলে গাজিয়াবাদ পৌঁছে যায় বলে হিন্দুস্তান টাইমস-এ খবর বের হয়। দুবেকে নাকি একটা হোটেলেও দেখা যায়, কিন্তু পুলিশ এসে পৌঁছনর আগেই সে পগার পার। হামিরপুরে পুলিশ দুবের অন্যতম সহযোগী অমর দুবে-কে গুলি করে মারে এবং তাদের দলের অন্য পাঁচ জনকে নানা জায়গা থেকে গ্রেফতারও করে।
৯ জুলাই দুটি পৃথক ঘটনায় দুবের দুই সঙ্গী পুলিশের গ্রেফতারি থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের গুলি করে মারা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসের সংবাদ অনুযায়ী, প্রবীণ দুবে উত্তরপ্রদেশের এটাওয়া জেলায় পুলিশি হেফাজত থেকে পালানোর চেষ্টা করলে গুলিতে নিহত হয়, আর ফরিদাবাদ থেকে এক অভিযানে গ্রেফতার হওয়া প্রভাত মিশ্রকে যখন কানপুরে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখন সে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
"কানপুরের পথে পানকি-তে পুলিশরা পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির টায়ার পাল্টাচ্ছিল, আর তখনই প্রভাত মিশ্র পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে গুলি করে মারে" হিন্দুস্তান টাইমসকে একটি বয়ানে বলেন আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এডিজি প্রশান্ত কুমার।
আরও পড়ুন: ভাইরাল পোস্টের সাইকেল কন্যা জ্যোতি পাসওয়ানের ধর্ষণ ও খুনের খবরটি ভুয়ো
বিকাশ দুবের গ্রেফতারি
৯ জুলাই উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের নিজস্ব বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীরা দুবেকে দেখতে পেয়ে খবর দিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, মন্দির চত্বরে এক দোকানদার দুবে-কে চিনে ফেলে এবং ওই মন্দিরের রক্ষীদের খবরটা জানায়, তারা আবার পুলিশের কাছে খবরটা পৌঁছে দেয়।
মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র জানান, দুবে উজ্জয়িনীতে আসে রাজস্থানের কোটা থেকে, সঙ্গে দুই সাগরেদকে নিয়ে। গ্রেফতারির পরই দুবেকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যারা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কানপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
পিটিআই জানাচ্ছে, দুবের স্ত্রী রিচা, তাদের পুত্র এবং বাড়ির এক পরিচারককে লখনউতে তাদের বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিকাশ দুবের স্ত্রী রিচাকে ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার চেষ্টা হচ্ছে যে পুলিশের উপর অতর্কিত হামলার ছক কষার জন্য প্রযোজনীয় ভিতরের খবরগুলো কে কী ভাবে বিকাশের দলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
এনকাউন্টার
১০ জুলাই সকালে পুলিশ দুবেকে গুলি করে হত্যা করে। অভিযোগ—দুবে নাকি পালানোর চেষ্টা করছিল। কানপুরের সহকারী পুলিশ সুপার অনিল কুমারের মতে, দুবেকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটা রাস্তায় একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে উল্টে যায়। আর দুবে নাকি একটা সার্ভিস রিভলভার ছিনতাই করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
Kanpur: According to police, 4 policemen were injured after a car from UP STF convoy bringing back #VikasDubey from Madhya Pradesh, overturned today morning. pic.twitter.com/rI0RMpWXwz
— ANI UP (@ANINewsUP) July 10, 2020
তখন নাকি বিকাশ দুবেকে পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে বলে, কিন্তু দুবে সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে দুজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করে জখম করে দেয়। পুলিশ পাল্টা গুলি চালায় এবং আহত গুলিবিদ্ধ দুবেকে দ্রুত কানপুরের এলএলআর হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে চিকিৎসকরা বিকাশ দুবেকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
#WATCH Vikas Dubey attempted to flee by snatching pistol of the injured policemen after car overturned. Police tried to make him surrender, during which he fired at the policemen. He was injured in retaliatory firing by police. He was later rushed to the hospital: SP Kanpur West pic.twitter.com/ZajJVLNGBU
— ANI UP (@ANINewsUP) July 10, 2020
তবে এই তথাকথিত এনকাউন্টারটি কোন ভুয়ো সাজানো সংঘর্ষ কিনা তা নিয়ে নানা সংশয় ও সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। যে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়ে আর যে গাড়িতে করে দুবেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই দুটি গাড়ি আলাদা।
First a Tata Safari, then a TUV 300: #VikasDubey's car was switched hours before the encounter. pic.twitter.com/HnymHvy4Re
— NDTV (@ndtv) July 10, 2020
পুলিশ ঘটনার যে বয়ান প্রচার করছে, স্থানীয় মানুষজন তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন। এনডিটিভির প্রতিবেদনে প্রকাশ, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা গুলির আওয়াজ শুনেছেন বটে, কিন্তু কোনও গাড়ি দুর্ঘটনার কথা কেউ বলেননি। পুলিশ স্থানীয়দের অকুস্থল থেকে সরিয়ে দেয় বলেও জানানো হয়েছে।
Watch | "How is the divider not broken if hit by speeding car?": locals question cops' version of #VikasDubey's encounter pic.twitter.com/Qg9B3ve0VA
— NDTV (@ndtv) July 10, 2020
সংবাদসংস্থা এএনআই জানাচ্ছে, উজ্জয়িনী থেকে যে সব সংবাদদাতারা বিকাশ দুবেকে নিয়ে যাওয়া পুলিশ কনভয়ের অনুসরণ করছিলেন, পুলিশ তাঁদের কানপুরের কাছে সাচেন্দি এলাকায় থামিয়ে দেয়, আর এগোতে দেয়নি।
#WATCH Media persons, who were following the convoy bringing back gangster Vikas Dubey, were stopped by police in Sachendi area of Kanpur before the encounter around 6.30 am in which the criminal was killed. (Earlier visuals) pic.twitter.com/K1B56NGV5p
— ANI UP (@ANINewsUP) July 10, 2020
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স একটি প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছে, এক পাল গরু হঠাৎ করেই ছুটতে ছুটতে জাতীয় সড়কের ওপর উঠে আসে, যাদের বাঁচাতে গিয়ে গাড়ির চালক এমন ভাবে স্টিয়ারিং ঘোরায় যে গাড়িটি ভাসরাম্য হারিয়ে উল্টে যায়।
STF issues press note in #VikasDubey encounter matter. "A herd of cattle had come in front of the vehicle due to which driver took sudden turn leading to accident...Police tried to go close to him to nab him alive but he continued to fire. Police retalitaed in self-defence..." pic.twitter.com/iOXaXv8vno
— ANI UP (@ANINewsUP) July 10, 2020
Updated On: 2020-07-14T15:12:04+05:30
Next Story