রাজস্থানে করোনাভাইরাসের কবলে ছাগল? খাসির মাংস কতটা নিরাপদ
বুম খোঁজ নিয়ে জেনেছে, আজমেঢ়ে ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ছাগলের মড়কের খবরটি ভুয়ো। মুরগি ও খাসির মাংস খাওয়া নিরাপদ জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল ভিডিও ও ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে রাজস্থানের আজমেঢ়ে ভাইরাস ঘটিত মড়কে উজার হয়ে যাচ্ছে একের পর এক গ্রামের ছাগল এবং এরাজ্যে আমদানি হওয়া ছাগলের মাংসের মাধ্যমে নাকি 'নভেল করোনা' বা 'কোভিড১৯' ছড়াতে পারে মানবদেহে। এই সব ফেসবুক পোস্টে ছাগলের মাংস পরিহার করার উপদেশও দেওয়া হয়েছে।
বুম যাচাই করে দেখেছে রাজস্থানের আজমেঢ়ে ছাগলের ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার খবরটি ভুয়ো।
বুমকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটিরিনারি মাইক্রেবায়েলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুনাল বটব্যাল জানিয়েছেন, ''কোভিড১৯ মানবদেহের ভাইরাস। তা মুরগি বা ছাগলের আক্রমনের যে খবর ছড়ানো হচ্ছে তা নিতান্তই গুজব।''
আরও পড়ুন: চিকেন পক্সের পুরনো ছবি তারকেশ্বরে মরফিন ভাইরাসের প্রকোপ বলে শেয়ার হল
আজমেঢ়ের ভাইরাল ভিডিও
২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের ভাইরাল ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি খাসির বাজারে সারি সারি শুয়ে রয়েছে ছাগল। ভিডিও যিনি রেকর্ডিং করেছেন তিনি হিন্দিতে বলেন, তিনি দাঁড়য়ে রয়েছেন আজমেঢ়ের ছাগলের বাজারে। ওই ভিডিওতে বলা হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম ভাইরাস ঘটিত এই রোগে ছাগলের সংখ্যা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। পরে সংশোধন করে ওই ভিডিওতেই বলা হয় রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে ছাগল। মূলত ছাগল আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। ভিডিওটিতে তিনজন ব্যক্তির বক্তব্য রাখে। রেকর্ডিংকারী ভিডিওটির বক্তব্য সত্য প্রতিপন্ন করতে এই তিন ব্যক্তিকে দিয়ে বক্তব্য পেশ করায়।
এই ভিডিও শেয়ার করে ফেসবুক পোস্টটিতে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, ''খাসি মাংসে করোনা ভাইরাস''
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে। ভিডিওটি নীচে দেখুন।
ভিডিওটি টুইটারেও শেয়ার করা হচ্ছে একই বয়ানে। টুইটটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুম এই ভিডিওটিকে ইউটিউবে খুঁজে পায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১১ ডিসেম্বর ও ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ''আজমেঢ়ে ভাইরাস আক্রান্ত ছাগল'' এই নামে ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল।
খাসির মাংসে করোনা: ফেসবুক পোস্ট
ফেসবুকে বিভিন্ন সম্পর্কহীন ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে খাসির মাংসে কোরোনা মিলেছে। রোগাক্রান্ত ছামড়া ছাড়ানো ঝুলতে থাকা একটি প্রাণীর ছবি শেয়ার করা হচ্ছে এই পোস্টগুলিতে। এরকম একটি ফেসবুক পোস্টে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "দয়া করে খাসির মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ইতি মধ্যেই খাসি বা পাঁঠার মাংসের মধ্যে থাবা বসিয়েছে "নোভেল করোনা" ভাইরাস ... দিল্লি, মুম্বাই, গুজরাট সহ দক্ষিন ভারতের অঞ্চলে এই মারণ রোগের প্রকপ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানানো হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাগল আমদানি করার ফলে এই রোগ দেখা গিয়েছে।''
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
"খাসির মাংসের মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে'', এই ক্যাপশন সহ ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর ছবি শেয়ার করেছেন আরও অনেকে। সেরকম একটি পোস্টের দাবি, ''মুরগী নয় বরং ছাগল গোত্রীয় প্রাণীদের মধ্যে পাওয়া য়াচ্ছে CORONA ভাইরাস এর লক্ষণ, খুব সাবধান, খাসির মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।''
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম জয়পুরে পাইকারি ছাগল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আসিফ কুরেশির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি ওই ভিডিওটি আগে দেখেছেন বলে দাবি করেন। ভিডিওটি অসত্য ও গুজব বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ''এই মুহুর্তে ছাগলের এরকম কোনও রোগ আক্রমনের ঘটনা ঘটেনি। এই ধরণের কোনও ঘটনা ঘটলে সরা রাজ্যেই তা ছাগল ব্যবসায়ীরা জানতে পারত। আমাদের রাজ্যের সব মান্ডির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমরা কলকাতাতেও ছাগল পাঠাই।''
তিনি ভিডিওটির কতগুলি অসঙ্গতির কথা আমাদের জানান:
১) ভিডিওটিতে মেয়ে ছাগলের কথা বলা হয়েছে শুধুমাত্র, তাহলে ভাইরাস কী লিঙ্গ বৈষম্য করছে?
২) ভিডিওটিতে প্রাপ্তবয়স্ক বিক্রির উপযোগী ছাগল দেখা যায়, তাহলে বাচ্চা ছাগলরা নিস্তার পেল কীভাবে?
আসিফ কুরেশির অভিমত শীতের সময় ছাগল সাধরণত চরাতে নিয়ে যাওয়া হয়না। শীত চলে গেলে বৃদ্ধ ছাগলদের অনেকটা এরকম দেখতে লাগে। কেউ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরণের গুজব ছড়াচ্ছে বলে তার ধারণা।
আরও পড়ুন: মাছে মরফিন ভাইরাস? আবার ফিরলো পুরনো গুজব
ভিডিওর বক্তব্যে অসঙ্গতি
বুম আজমেঢ়ের পশুপালন দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ডঃ রীতা পদ্মনাভনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান ছাগল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়ার এই ধরণের খবর তাদের কাছে নেই। বুম পার্শ্ববর্তী জেলা পালি ও টঙ্কের প্রাণীসম্পদ বিকাশ বিভাগের যুগ্ম পরিচালকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জেনেছে, ছাগলের ভাইরাস রোগাক্রান্ত হওয়ার খবর তাদের কাছেও নেই।
গ্রামের পর গ্রাম খালি হয়ে যাচ্ছে বলার পর সংশোধন করে ওই ব্যক্তি বলেন 'বকরি' বেঁচে আছে তবে অসুস্থ। ভিডিওটিতে কোনও গ্রামের ছবি অবশ্য দেখা যায় না সম্ভবত সেটি একটি মান্ডি বা ফ্রার্মের ছবি। এক ব্যক্তি বলেন তিনি ৩ সপ্তাহ ধরে দেখছেন অসুস্থতা নিরাময়ের কোনও লক্ষণ নেই। ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। ছাগল কারবারিরা বা প্রাণীসম্পদ বিভাগ এখবর জানেন না?
ছাগল ও মুরগীর মাংস কি নিরাপদ?
বুম পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটিরিনারি মাইক্রেবায়েলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ কুনাল বটব্যালের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি জানান, ''কোভিড১৯ মানবদেহের ভাইরাস। তা মুরগি বা ছাগলের আক্রমনের যে খবর ছড়ানো হচ্ছে তা নিতান্তই গুজব।''
বুম ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ডঃ পার্থ সারথি জানার সঙ্গে কথা বলেছে। যিনি ভেটিরিনারি এপিডোমলোজি এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক। তিনি বলেন, ''এই সময় ছাগল অন্যান্য ভাইরাস ঘটিত রোগে আক্রান্ত হয় যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অসুস্থতা সারলে সেই ছাগলের মাংস খাওয়ার অসুবিধা কোথায়। ছাগলে 'করোনা' সংক্রমণের খবরগুলো সবই ভুয়ো।''
বোভাইন করোনাভাইরাস
বুম ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়ো টেকনোলজি ইনফর্মেশনের ওয়েবসাইট এবং সংযুক্ত স্বাস্থ্য ও জীব বিজ্ঞানের জার্ণাল পাবমেডে বিভিন্ন বোভাইন করোনাভাইরাস বা বিসিভির ব্যাপারে প্রবন্ধের হদিস পেয়েছে যা মূলত গৃহপালিত বা বন্য পশু যেমন গরু, ছাগল, জিরাফ, সম্বর হরিণ ইত্যাদি প্রাণীদের শ্বাসজনিত ও শীতকালীন ডায়েরিয়া রোগ সৃষ্টি করে। এব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পারেন এখানে।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মুরগি? ভুয়ো খবর