এই ছবিগুলি আর ভিডিওটিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেখানো হচ্ছে না
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে ভ্যাকসিন বাজারে এসে গেছে—মিথ্যে দাবি সহ এই ছবিগুলি এবং ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে।
কয়েকটি ছবি এবং একটি ভিডিও ক্লিপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওষুধ কম্পানি রোচে'কে ধন্যবাদ জানাতে দেখা যাচ্ছে। সেই ফটো এবং ভিডিও ক্লিপটি এক সঙ্গে এই বলে শেয়ার করা হচ্ছে যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেছে।
ভাইরাল হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডে যা রয়েছে তা হল: কোরিয়ায় তৈরি কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার কিট, অন্য করোনাভাইরাস সংক্রান্ত পুরনো পেটেন্ট, এবং আগেই খণ্ডন করা একটি ভাইরাল ভিডিও যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত কোভিড-১৯ পরীক্ষা সম্পর্কে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন।
ভাইরাল ছবির কোলাজ ও ভিডিও ক্লিপটির সঙ্গে দেওয়া ক্যাপশনে বলা হয়েছে, "দারুণ খবর! করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরি। ইঞ্জেকশন দেওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে নিরাময় হয়। মার্কিন বিজ্ঞানীদের সেলাম। ট্রাম্প এইমাত্র ঘোষণা করলেন যে, আগামী রবিবার রোশ মেডিক্যাল কম্পানি ভ্যাকসিনটি বাজারে ছাড়বে। কয়েক লক্ষ ডোজ তাদের কাছে রয়েছে!!!"
কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার কিট একই দাবি সমেত একক ভাবেও ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
কয়েকটি পরিভাষার মানে জেনে নেওয়া প্রয়োজন—যেমন, করোনাভাইরাসেস, নোভেল করোনাভাইরাস, এসএআরএস-সিওভি২ বা এইচসিওভি-১৯ ও সিওভিডি-১৯।
করোনাভাইরাসেস: একটি ভাইরাস পরিবার যার সদস্যরা সাধারণ সর্দি-কাশি, সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম (এসএআরএস বা সারস) এবং মিডিল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম (এমইআরএস বা মেরস) জাতীয় অসুখের কারণ।
নতুন করোনাভাইরাসটি হল করোনাভাইরাসের একটি নতুন সংস্করণ, যার নাম এইচসিওভি-১৯। এখন সেটি সারস-কোভ-২ ভাইরাস নামে পরিচিত।
এবং সারস-কভ-২ ভাইরাস যে অসুখটি সৃষ্টি করে, তার নাম কোভিড-১৯।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করার কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই গবেষণাগুলি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি যদি সফলও হয়, ২০২১-এর শুরুর আগে সেগুলির বাজারে আসার সম্ভাবনা নেই।
ভাইরাল বার্তাটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। 'কোভিড-১৯ ১জিএম/১জিজি' লেখা বাক্সের ছবিটি আসলে পরীক্ষা করার কিটের, ভ্যাকসিনের নয়। দুটি পেটেন্টের স্ক্রিনশটের একটি হল, মানুষের নয়, মুর্গির মধ্যে পাওয়া ভাইরাসের পেটেন্ট। অন্যটি হল করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিকিৎসার পেটেন্ট। কিন্তু সেটি অন্য এক করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর যে ক্লিপে ট্রাম্পকে দেখা যাচ্ছে, সেটি হল রোশকে করোনাভাইরাস টেস্ট করার ছাড়পত্র দেওয়ার দৃশ্য। সেটি ভ্যাকসিন বাজারজাত করার দৃশ্য নয়।
কোভিড-১৯ টেস্ট কিটের ছবি
যে মেডিক্যাল কিট দেখা যাচ্ছে, কোরিয়া সম্প্রতি সেটি তৈরি করেছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ছোট ছোট প্যাকেট, একটি ড্রপার এবং কাগজে লেখা নির্দেশাবলি ও একটি বাক্স। এবং সেগুলির গায়ে লেবেল সাঁটা। তাতে লেখা, "এসজিটিআই-ফ্লেক্স কোভিড-১৯ ১জিএম/১জিজি"। বুম দেখে, ছবিটি হল নোভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার কিটের ছবি। দক্ষিণ কোরিয়ার সুগেনটেক মেডিক্যাল কম্পানি সেটি তৈরি করছে। খবরে প্রকাশ ওই কিট ১০ মিনিটের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেয়। টেস্ট কিটটি সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন এখানে।
Korea finished developing the 10 minute Covid-19 diagnostic kit and is now ramping up production. They plan to export 300.000 test-kits per week - pic.twitter.com/DpJCph9RT7
— Florian Witulski (@vaitor) March 21, 2020
করোনাভাইরাস পেটেন্টের স্ক্রিনশট
দু'টি ছবিতে দাবি করা হয়েছে যে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ আর ২০১৮ সালে পেটেন্টের জন্য দরখাস্ত করা হয়।
স্ক্রিনশটটি হল ২০১৮ সালের পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটের পেটেন্টের। ওই পেটেন্টে দাবি করা হয়েছে যে, নোভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। পিরব্রাইট ইনস্টিটিউট আরও স্পষ্ট করে জানায় যে, তারা 'ইনফেক্সাস ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস' নিয়ে গবেষণা করে এবং সেটি হল একটি করোনাভাইরাস যেটি মুর্গি আর শুয়োরের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। তার মানে, ভ্যাকসিনটি মানুষের ব্যবহারের জন্য নয়। সেটি পশু পাখিদের মধ্যে সংক্রমণ ঠেকাতেই ব্যবহার করা হয়। বুম আগেও ভাইরাল দাবিটি খণ্ডন করেছিল।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের পেটেন্ট রয়েছে? সোশাল মিডিয়ার পোস্টগুলি কেন বিভ্রান্তিকর
পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছে, "পিরব্রাইট বর্তমানে মানুষের করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করছে না। এই ইনস্টিটিউটের রয়েছে পেটেন্ট নং ১০১৩০৭০১। সেটি এক ধরনের দুর্বল করোনাভাইরাস সৃষ্টি সংক্রান্ত, যেটি পশু, পাখিদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের অসুখ ঠেকাতে কাজে লাগাতে পারে। ফ্লু থেকে পোলিও, অনেক ভ্যাকসিনই এভাবেই প্রস্তুত হয়। আমরা এখনও কোনও আইবিভি ভ্যাক্সিন তৈরি করিনি, কিন্তু গবেষণা চলছে।"
লুডউইগ ম্যাক্সিমিলিয়নস ইউনিভার্সিটির পেটেন্ট
দ্বিতীয় স্ক্রিনশটটি হল মিউনিখের লুডউইগ ম্যাক্সিমিলিয়নস ইউনিভার্সিটির পেটেন্টের। তার জন্য আবেদন করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। পেটেন্টটি করোনাভাইরাসের বৃহত্তর পরিবার সংক্রান্ত। পেটেন্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে, "করোনাভাইরাস ইনফেকশন বলতে এখানে বোঝাচ্ছে, ইনফেকশন, যার মধ্যে পড়ছে যে কোনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি, যেমন মানুষের করোনাভাইরাস এইচসিওভি-এনএল৬৩, এইচসিওভি-ওসি৪৩, এইচসিওভি-২২৯ই, এইচসিওভি-এইচকেইউ১, সারস-এইচসিওভি (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি করোনা ভাইরাস), এইচসিওভি-এমইআরএস (মিডিল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম ভাইরাস, যাকে আগে বলা হত 'ইএমসি')।"
তবে এইচসিওভি-১৯ বা এসএআরএস-এইচসিওভি২ ভাইরাস থেকে যে কোভিড-১৯ অসুখ সৃষ্টি হয়, তার চিকিৎসা এই পেটেন্টের অন্তর্ভুক্ত নয়। (পেটেন্টটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে)
রোচে ডায়েগনস্টিকের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ট্রাম্প
ভাইরাল হওয়া মেসেজে যে ভিডিওটি রয়েছে, সেখানে রোচে ডায়েগনস্টিক (উত্তর আমেরিকা)-র প্রেসিডেন্ট ও প্রধান কার্য নির্বাহী অফিসার ম্যাথিউ সওসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ও সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), এই দুই সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাতে দেখা যাচ্ছে। তার কারণ, করোনাভাইরাস টেস্ট করার সরঞ্জাম প্রস্তুত করার অনুমতি দেওয়া হয় তাঁদের প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। তথ্য যাচাই করে বুমই প্রথম জানিয়েছিল যে, রোচেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার সরঞ্জাম তৈরি করার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, ভ্যাকসিন তৈরির জন্য নয়।