ট্রিবিউন, ইন্ডিয়া টুডে অনলাইন শিক্ষকের হেনস্থার আষাঢ়ে গল্প প্রচার করছে
বাংলাদেশের এক ফেসবুক ব্যবহারকারীর একটি কাল্পনিক গল্পকে সংশ্লিষ্ট সংবাদ-মাধ্যমগুলি সত্যি ঘটনা বলে প্রচার করছে।
৫৫ বছর বয়স্ক এক স্কুল-শিক্ষককে তাঁর ছাত্ররা অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সময় হেনস্থা করেছে, এই মর্মে প্রকাশিত একটি কাল্পনিক ছোট গল্পকে ইন্ডিয়া টুডে, ট্রিবিউন, ইন্ডিয়া টিভি প্রভৃতি সংবাদমাধ্যম সত্য ঘটনা বলে প্রচার করছে। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এই গল্পটিকে এই সংবাদমাধ্যমগুলি সত্য ঘটনা বলে প্রচার করছে এমন একটা সময়ে, যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ জনিত দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে স্কুলের পঠন-পাঠন অনলাইনে চালু করা হয়েছে।
বুম দেখলো, এই ভুয়ো খবরটির উৎস হলো বাংলাদেশের এক ফেসবুক ব্যবহারকারীর একটি বিবরণী, যার নীচে স্পষ্টই লেখা ছিল যে, এটি সত্য ঘটনা নয়, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সময় হেনস্থা হওয়া শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানাতে তৈরি করা একটি কাল্পনিক গল্প।
ইন্ডিয়া টুডে, দ্য ট্রিবিউন, ইন্ডিয়া টিভি এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস এই রিপোর্টটি ছেপেছে সঙ্গে এক মধ্যবয়স্ক শিক্ষকের ছবি সহ, যিনি জুম ভিডিও কলিং অ্যাপ-এর মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। তার মধ্যে আইবি টাইমস এই ভুলটা সংশোধন করে নিয়েছে যে, প্রচারটি ভুয়ো এবং কাল্পনিক, কিন্তু অন্য সংবাদমাধ্যমগুলি এখনও ভুল স্বীকার করেনি।
একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে: "হঠাৎ একটি অচেনা আই-ডি থেকে শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে নোংরা-নংরা গালাগালি দেওয়া হতে থাকে এবং হুমকিও দেওয়া হতে থাকে। প্রবীণ এই শিক্ষক কী ভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি চিত্কার করে বলতে থাকেন, একজন শিক্ষককে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সামনে অপমান করা হচ্ছে, তাঁর সারা জীবনের কাজ এবং ছাত্রদের কাছে অর্জিত সম্মান-শ্রদ্ধা মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাঁর কন্যা তাঁকে তাঁর আওয়াজটা কমিয়ে রাখার পরামর্শ দেন, কিন্তু ছাত্ররা আবার আওয়াজ বাড়িয়ে নিতে জানে। ওই বিশেষ ছাত্রটি অশালীন গালাগাল দিতেই থাকে এবং গোটা ব্যাপারটা থেকে বেশ একটা মজা আহরণ করতে থাকে। আর কোনও বিকল্প রাস্তা না পেয়ে নিজের সম্মান রক্ষার্থে শিক্ষক অনলাইনে পড়ানো বন্ধ করে দেন।"
এই গল্পটা এমন একটা সময়ে ছড়ানো হয়েছে, যখন করোনা অতিমারীর কারণে নিয়মিত স্কুল খোলা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের পঠন-পাঠনের জন্য ভিডিও কলিং মারফত অনলাইন ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। একই সঙ্গে এই সব অনলাইন পাঠনের সময় ছাত্রদের দ্বারা অসম্মানিত হওয়া, গালি খাওয়া, এমনকী ভয় দেখানোর অভিযোগও শিক্ষকের তরফে নথিভুক্ত হয়েছে।
সংবাদ-মাধ্যমগুলি ইনস্টাগ্রাম পোস্টকে উল্লেখ করেছে
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনটি টেড দ্য স্টোনার নামে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টকে তার খবরের উৎস হিসাবে বর্ণনা করেছে, যার অনুগামীর সংখ্যা ১৪ লক্ষ। এই পোস্টটি আবার ২০২০ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী সৈয়দ মহম্মদ ফাহিমের একটি পোস্টকে তার উত্স হিসাবে উদ্ধৃত করেছে। ইনস্টাগ্রাম পোস্টটিতে একবারের জন্যও উল্লেখ করা হয়নি যে, এই খবরটি কোনও সত্য ঘটনা নয়, একটা বানানো গল্প।
ফেসবুকের পোস্টটিতে কোনও ছবি দেওয়া নেই, কিন্তু ইনস্টাগ্রামের পোস্টটিতে একটি ছবি সংযোজন করা হয়েছে আর সংবাদ-মাধ্যমগুলি সেটাই অবিকল ছেপেছে।
টেড দ্য স্টোনার অবশ্য পরে একটি ক্যাপশন দিয়ে জানায় যে, পোস্টটি কাল্পনিক।
আরও পড়ুন: ১৪০ নম্বর থেকে ফোন: মিথ্যে দাবির সঙ্গে ভাইরাল হল মুম্বই পুলিশের ভিডিও
তথ্য যাচাই
বুম দেখেছে যে, ফেসবুকের এই পোস্টটি একটি কাল্পনিক গল্প যা বাংলাদেশেরই এক শিক্ষক অনলাইনে পঠন-পাঠনে শিক্ষকদের হেনস্থার ওপর আলোকপাত করতে তৈরি করেছেন।
সৈয়দ মহম্মদ ফাহিমকে নিয়ে অনুসন্ধান করে ফেসবুকে তাঁর যে প্রোফাইলের খোঁজ মিলেছে, তাতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রথম এই গল্পটি সেখানে পোস্ট হয়। সেখানে ওই দিনই ফাহিমের পোস্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, গল্পটি কাল্পনিক।
সেখানে বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে কী ভাবে ৫৫ বছর বয়স্ক এক শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নেবার সময় তাঁর ছাত্রদের হাতে হেনস্থা, অপদস্থ ও অসম্মানিত হয়েছেন। পোস্টের একেবারে শেষে একটি বক্তব্যে লেখা হয়েছে, "আমি এই কাল্পনিক গল্পটি লিখলাম জুম মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস নিতে গিয়ে নির্লজ্জ ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানাতে।" যার অর্থ, এটি কোনও সত্য ঘটনার বিবরণ নয়।
সংবাদ-মাধ্যমগুলি একটি ছবি দিয়ে পোস্টটি ছেপেছে এটা বোঝাতে, যেন অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সময় এই শিক্ষকই ওই হেনস্থা-হয়রানির শিকার হয়েছেন, যেটি সম্ভবত একটি স্ক্রিনশট। ভাইরাল হওয়া ছবিটির খোঁজ করে আমরা অন্য এক বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী হাফিজ আর রহমানের একটি ভিডিও দেখতে পাই, যিনি একই গল্প ১১ জুলাই পোস্ট করেন।
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন শিক্ষক জুম অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন এবং তা করতে গিয়ে দৃশ্যতই পড়ুয়াদের দ্বারা অপদস্থ হচ্ছেনl রহমানের মতে ওই শিক্ষকের নাম মহিউদ্দিন, যিনি ঢাকার মাইলস্টোন কলেজে অনলাইনে ছাত্রদের ক্লাস নিচ্ছেন। ভিডিওটি নিয়ে রহমানের দাবির সত্যতা বুম নিজে থেকে যাচাই করে দেখতে পারেনি।
আরও পড়ুন: বিভ্রান্তিকর দাবি সহ ছড়ালো নরেন্দ্র মোদী ও আমিত শাহের সম্পাদিত ছবি