লিবিয়া উপকূলে অভিবাসীদের নৌকাডুবির ভিডিওকে বলা হল করোনাভাইরাসে মৃত লাশ
বুম দেখে ভিডিওটি ২০১৪ সালের, সেই সময় লিবিয়ার উপকূলে নৌকাডুবির ফলে মৃতদেহ তীরে ভেসে আসে।
২০১৪ সালে লিবিয়ার উপকূলে একটি নৌকাডুবির ফলে অভিবাসী আফ্রিকান শ্রমিকদের মৃতদেহ সমুদ্র তীরে ভেসে আসছে, ওই ঘটনার এক হৃদয়বিদারক ভিডিওকে ভুয়ো দাবি সহ নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে জুড়ে সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে।
ভিডিওটির সাথে একটি বিভ্রান্তিকর ক্যাপশন লেখা আছে, যেখানে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের সময় নেটিজেনদের সামুদ্রিক খাবার গ্রহন করা থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে, কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে কিছু দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের মরদেহ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
এই বিভ্রান্তিকর দাবি হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকে উভয় মাধ্যমেই ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল পোস্টে ক্যাপশনে বলা হয়েছে, "কিছু দেশ, কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের মরদেহ সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। সামুদ্রিক খাবার না-খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবী সত্যিই শেষ হয়ে আসছে। হে ভগবান, দয়া করে হস্তক্ষেপ করুন।"
(মূল ইংরেজি ক্যাপশন: "Some countries throw Covid19 infected dead bodies into the seas. Advice to stop eating seafood. The World is really coming to an end. Dear God, please intervene.")
বিশ্ব জুড়ে নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১,৮৩,০০০। ইতালি আর স্পেন এখন কোভিড-১৯ এর নতুন উৎসকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ৮.৫ লক্ষ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত। এই অতিমারির সংক্রমণ রুখতে, অনেক দেশ সম্পূর্ণ লকডাউনের মধ্যে আছে।
আরও পড়ুন: জনস হপকিন্স নিজে থেকেই জানালো কোভিড-১৯ ভাইরাল সতর্কতা তালিকা তাদের নয়
তথ্য যাচাই
ভাইরাল হওয়া ভিডিওকে কয়েকটি ফ্রেমে আলাদা করে নিয়ে বুম ইন্টারনেটে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে। বুম এই ঘটনা সংক্রান্ত আসল তথ্য খুঁজে পায়। ভাইরাল ভিডিওটি ২০১৪ সালে লিবিয়ার সমুদ্র উপকুলে ঘটে যাওয়া একটি নৌকাডুবির ঘটনার। একটি খবরের প্রতিবেদন অনুযায়ী লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র তটে উক্ত নৌকাডুবিতে মৃতদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। মৃতেরা সবাই আফ্রিকার ছিলেন, তারা সমুদ্রপথে বেআইনি ভাবে আফ্রিকা থেকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের দিকে যাচ্ছিলেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিও সহ অভিবাসীদের নৌকা ডুবির ঘটনার একটি আরবি ভাষায় করা প্রতিবেদন সংগ্রহ করে বুম, যেখানে বলা হয়েছে ১৭০ জন ইউরোপগামী অবৈধ আফ্রিকীয় অভিবাসী লিবিয়ার সমুদ্র উপকুলে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও লিবিয়ার নৌ সেনা ১৭ জন নৌযাত্রীকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে।
ইংল্যান্ডের টেবলোয়েড পত্রিকা ডেইলি মেইল-এর একটি প্রতিবেদনে সমুদ্রতীরে এই দুর্ঘটনায় উদ্ধারকার্যের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বুম দেখে যে ভাইরাল ভিডিওটির একটি ফ্রেম গেট্টি ইমেজের চিত্রগ্রাহক মাহমুদ তুরকিয়ার তোলা একই দুর্ঘটনার একটি ছবির সাথে মিলে যায়।
সতর্কতা: নীচের ছবিটি আপনাকে বিচলিত করতে পারে।
ছবিটির ক্যাপশনে বলা হয়, "২৫ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে ত্রিপলি থেকে ৬০ কিমি পূর্বে, উদ্ধারকর্মীরা আল-কারবোলে তট থেকে অবৈধ অভিবাসীদের মরদেহ তুলছেন। এর দু'দিন আগে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল থেকে ২০০ অবৈধ অভিবাসীকে নিয়ে রওনা দিয়ে একটি নৌকা লিবিয়ার রাজধানী থেকে কিছু দূরে ডুবে যায়। লিবিয়ায় এখন চরম বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। লিবিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা সুন্দর জীবনের আশায় ইউরোপের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ভূমধ্যসাগর পেরনোর জন্য তাঁরা মানুষ পাচারকারীদের সাহায্য নিচ্ছেন।"
(মূল ইংরেজি ক্যাপশন,"Rescue workers pull the bodies of illegal immigrants onto shore of al-Qarbole, some 60 kilometres east of Tripoli on August 25, 2014 after a boat carrying 200 illegal immigrants from sub-Sahara Africa sunk off the Libyan capital two days earlier. Libya, which is mired in unrest and political chaos, has been a launchpad for illegal migrants seeking a better life in Europe but who turn to people smugglers to get them across the Mediterranean.")
এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। ওই সময় আফ্রিকার বহু মানুষ সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, মনে করা হয় সমুদ্র তখন শান্ত থাকে। ডেইলি মেল-এর প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়,"প্রায় ২০০ অভিবাসী ডুবে গেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপের মূল অংশে যাওয়ার চেষ্টা করার সময়, তাঁদের নৌকা লিবিয়ার উপকূল থেকে এক মাইল দূরে ডুবে যায়। ছোট জলযানটি পুরুষ, মহিলা এবং শিশুতে বোঝাই ছিল। স্থানীয় উপকূলরক্ষী বাহিনীর কথা অনুযায়ী, নৌকাটি শুক্রবার রাতে ডুবে যায়।"
২০১৪-১৫ সাল নাগাদ লিবিয়া সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দেশগুলি থেকে অবৈধভাবে ন্যুনতম নিরাপত্তা ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে থাকে। অনেকেরি নানান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। আইলান কুর্দি নামের একটি শিশুর নিথর মৃতদেহ সমুদ্র সৈকতে উপুড় হয়ে পরে আছে, এইরকম একটি ছবি সে সময় সোশাল মিডিয়ায় তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে যে, কোভিড-১৯-এ মৃত ব্যক্তিদের দেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও। তবে সংস্থাটি এও বলেছে যে, কোভিড-১৯-এ মৃতদের সৎকার তাড়াহুড়ো করে করা ঠিক নয়। এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা দেখা যাবে এখানে। করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ব্যাপকহারে প্রাণহানী ঘটছে ইউরোপের দেশগুলিতে, বুম আগেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃতদেহের সৎকার এবং কবরস্থ করা নিয়ে বিভিন্ন ভাইরাল পোস্টের তথ্য যাচাই করেছে।
আরও পড়ুন: মিথ্যে: করোনাভাইরাস তৈরি করার জন্য গ্রেপ্তার হলেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক