মিথ্যে: বিভিন্ন ধরনের চা পানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারতে পারে
চায়ের ক্যাফেইন মানব শরীরের ঘুম ঘুম ভাব ও ক্লান্তি দূর করতে পারে কিন্তু কোভিড-১৯-এর ওপর প্রভাবের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
ভাইরাল বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে, বিভিন্ন জিনিস দিয়ে তৈরি চা, মারণ করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ থেকে যে অসুখ বাঁধে, তা সারিয়ে তোলার পরীক্ষিত ওষুধ। কিন্তু এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, এখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর কোনও অনুমোদিত চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই।
দু'টি বার্তায় যা দাবি করা হয়েছে, তা হলো:
১. লেবু আর বাইকার্বোনেট (বেকিং সোডা) দিয়ে তৈরি চা শরীরকে অ্যালকালাইন করে অ্যাসিডমুক্ত করে। আর সেই সঙ্গে বাড়িয়ে তোলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা। ইজরেয়েলের মানুষজন ওই চা রোজ খেয়ে থাকেন। তাই সে দেশে কোভিড-১৯-এ কেউ মারা যাননি।
এই দাবিটি দু'টি কারণে মিথ্যে। এক, এই পানীয়টি যে শরীরের পিএইচ মাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, এই ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। দুই, ইজরায়েলে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ১৩, ১০৭ জন এবং (এখনও পর্যন্ত) মারা গেছেন ১৫৮ জন, এই তথ্য দিয়েছে জনহপকিন্স ইউনিভার্সিটি।
২. দ্বিতীয় বার্তায় দাবি করা হয়েছে, ডঃ লি ওয়েনলিয়াং, যিনি নতুন ভাইরাসটি সম্পর্কে প্রথম সতর্ক করেন বিশ্বকে এবং বন্দি অবস্থায় মারা যান, তিনি দেখেন গ্রিন-টি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এবং উহানের রোগীদের সারাতে নিয়মিত গ্রিন-টি দেওয়া হত।
যে চিকিৎসক প্রথম সতর্ক করেন ও ফেব্রুয়ারি মাসে নিজে কোভিড-১৯ অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তিনি ওই নতুন ভাইরাসের আবির্ভাবের কথা জানিয়ে ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনি যে করোনাভাইরাসের ওষুধের কথাও বলেছিলেন, সে রকম কোনও প্রমাণ নেই। তাছাড়া, গ্রিন-টির উপাদানগুলি যে কোভিড-১৯ সারিয়ে তোলে, তাও বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত নয়।
এই দু'টি পোস্ট ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে ব্যাপক ভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। বার্তা দু'টি একাধিকবার বুমের হেল্পলাইনে আসে।
বুম আগেও কয়েকটি পোস্ট খণ্ডন করেছিল। সেগুলিতে নভেল করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ও প্রতিষেধকের উল্লেখ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবারই বলেছে যে, করোনাভাইরাসের ওষুধ ও প্রতিষেধক তৈরি করার কাজ চলছে এবং পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে সেগুলি। বর্তমানে অসুখটির কোনও প্রতিষেধক বা চিকিৎসা নেই।
আরও পড়ুন: হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করে? একটি তথ্য যাচাই
তথ্য যাচাই
দাবি: 'গরম চা হিসেবে লেবু আর বাইকার্বোনেট দিয়ে তৈরি পানীয় খান। সেটি ভাইরাসটিকে মারে। রাতে শরীরে অম্লতা বেড়ে যায় আর এই পানীয় শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অ্যালকালাইন করে। ইজরেয়েলিরা এই চা খান বলে তাঁদের কোনও চিন্তা নেই, এবং কোনও মৃত্যুও ঘটেনি সেখানে।'
ইজরেয়েলিরা চিন্তিত নন, বা সে দেশে কেউ মারা যাননি, এই দাবি মিথ্যে। জন হপকিন্স ইউনিভারসিটির তথ্য অনুযায়ী, ইজরায়েলে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ১৩, ১০৭ জন এবং (এখনও পর্যন্ত) মারা গেছেন ১৫৮ জন। ইজরেয়েলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী ২ এপ্রিল ২০২০-তে নভেল করোনা পজিটিভ হয়েছেন জানা গেছে।
তাছাড়া লেবু আর বেকিং সোডার (বাইকার্বোনেট) মিশ্রন ভাইরাসটিকে মেরে ফেলে, এই দাবি বিজ্ঞান সম্মত নয়। আমেরিকার তথ্য-যাচাই সংস্থা 'স্নোপস' আগেই ওই দাবি খণ্ডন করে।
মানুষের শরীরের স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রা হল ৭। পিএইচ-এর মাত্রাই যে কোনও সল্যুশন বা তরল পদার্থের অম্লতা (অ্যাসিডিক ভাব) বা ক্ষার (অ্যালকালাইন ভাব) নির্ধারণ করে। মানুষের রক্তের পিএইচ মাত্রা হলো ৭.৪। অর্থাৎ, তা হলো অ্যালকালাইন। অপর দিকে পাকস্থলি হল অ্যাসিডিক, যা খাবার হজম করতে সাহায্য করে।
লেবুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি আছে। শ্বাসনালির ওপর ভিটামিন-সির প্রভাব সম্পর্কে অনেক দিন ধরে বিতর্ক চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফহেল্থ' অবশেষে জানিয়েছে যে, প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি খেলেও সাধারণ ঠান্ডা লাগার ভাইরাসকে কাবু করা যায় না। আর সেই তুলনায়, একটি লেবুতে তো থাকে মাত্র ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি।
তাছাড়া ল্যাবরেটারির পরিবেশ ছাড়া বা 'অ্যাসিডোসিস'-এর মতো অসুখ না থাকলে, মানুষের শরীরের পিএইচ মাত্রা সাধারণ ভাবে নড়চড় হয় না।
অ্যাসিডের মাত্রা বেশি, সেই রকম খাবার খেলেও শরীরের অ্যাসিডিক বা অ্যালকালাইনে তারতম্য ঘটে না। ফলে, বাইকার্বোনেট ও লেবু যে নতুন করোনাভাইরাসকে প্রভাবিত করে, গবেষণা ওই দাবিটি সমর্থন করে না।
আরও পড়ুন: না, ভাইরাল এই ভিডিওর ব্যক্তি এইমসের ডাক্তার অর্কপ্রভ সিনহা নয়
দাবি: 'গ্রিন-টিতে পাওয়া যায় যে মেথিলজ্যানথাইন, থিওব্রোমাইন ও থিওফিলিন যৌগ, সেগুলিকে ওষুধ হিসেবে কাজে লাগানর প্রস্তাব দেন ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং এবং উহানের রোগীদের তা দেওয়া হয়।'
ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং চিনে নতুন ভাইরাসটির আবির্ভাব সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেন। সেই জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ওই করোনাভাইরাসেই আক্রান্ত হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে উনি মারা যান। কিন্তু তিনি যে কোভিড-১৯ অসুখের কোনও ওষুধ বার করেছিলেন, সে রকম কোনও প্রমাণ নেই।
তাছাড়া, গ্রিন-টির যৌগগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু সেগুলি যে করোনাভাইরাসের ওপর প্রভাব ফেলে তার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। ক্যাফিন এক ধরনের মেথিলজ্যানথাইন। সেটি শরীরে হাওয়া চলাচলে সাহায্য করে, কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পারে বলে জানা যায়নি। এই পানীয় ঝিমুনি আর ক্লান্তি কাটাতে সাহায্য করে। কিন্তু বেশি পরিমাণে খেলে, মাথা ধরে আর কাঁপুনিও হতে পারে।
এখনও পর্যন্ত, কোভিড-১৯-এর কোনও জানা ওষুধ নেই। যাঁরা ভাল হয়ে উঠেছেন, তাঁরা সুস্থ হয়েছেন তাঁদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার জোরে। এক্ষেত্রে যে সব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে এইচআইভি সারানোর ওষুধও। কিন্তু সব ওষুধই পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলির কোনওটাই করোনাভাইরাসের ওষুধ বলে এখনও চিহ্নিত হয়নি।
আরও পড়ুন: এই ছবিগুলি আর ভিডিওটিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেখানো হচ্ছে না