সিদ্ধার্থ শুক্লার প্রয়াণ: নীরোগ তরুণদেরও হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকি এখন
সিদ্ধার্থ শুক্লা নিয়মিত ব্যায়াম করতেন কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন রোজ তা সত্বেও চাপের কারণে কমবয়সীরাও ক্রমশ হৃদরোগের শিকার হচ্ছেন।
অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লা (৪০) (Sidharth Shukla) বৃহস্পতিবার ভোরবেলা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় সুস্থ্য এবং অল্পবয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack) এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের (Cardiac Arrest) সংখ্যা বাড়ার বিষয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠল।
নানাবতী হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের ডিরেক্টর ডাঃ লেখা পাঠক বুমকে জানালেন, "সাম্প্রতিক খবরগুলির দিকে নজর দিলে বোঝা যায় যে, এখন হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বয়স বা লিঙ্গ কোনওটাই আর বিবেচ্য নয়। ঠিক সময়ের মধ্যে চিকিৎসা পেয়ে কিছু মানুষ বেঁচে যাচ্ছেন, আর যাঁদের ক্ষেত্রে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাঁদের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট পর্যন্ত হচ্ছে।" তিনি আরও জানান যে, যদিও শুক্লা শারীরিক ভাবে খুব সবল মানুষ, কিন্তু মানসিক চাপ এবং ব্যায়ামের পর আরও বেশী চাপ নেওয়ার ফলেই হয়তো তাঁর শরীরের উপর বেশি চাপ পড়েছিল।
ডাঃ পাঠক জানিয়েছেন, "মানসিক চাপ, লাইফস্টাইল, ধূমপান, মদ, ড্রাগ এবং ব্যায়াম করার সময় শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার ফলে হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।"
ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে যে, শুক্লার বুকে ব্যথা হয় এবং সম্ভবত তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মারা গিয়েছেন। যদিও হার্ট অ্যাটাক এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু বিষয় দুটি আলাদা। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে হার্ট বিট হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি খুব খারাপ হয় এবং তাঁর হৃৎপিণ্ড সঙ্গে সঙ্গে চালু করার দরকার হয়। আর হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে আক্রান্তের হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে না, কিন্তু হৃৎপিণ্ডে রক্তের যাতায়াত বাধাপ্রাপ্ত হয়। হার্ট অ্যাটাক পরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে পরিণত হতে পারে।
মুম্বইয়ের লীলাবতী অ্যান্ড রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হসপিটালের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ অজিত মেনন জানিয়েছেন, "হৃৎপিণ্ডের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রথম ধাপ হল হার্ট অ্যাটাক, এবং দ্বিতীয় অবস্থা হল কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। শুক্লাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজিস্টের গভর্নর ডক্টর মনোজ গেরেলা জানিয়েছেন যে, ২০১২ সালে ভারতে আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, বিশ্বের ৩১ % মৃত্য ঘটে কার্ডিওভাসকুলার অসুখের কারণে। তবে এই পরিসংখ্যানের মধ্যে কতগুলি আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ফলে ঘটে, তা স্পষ্ট নয়।
গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজেস-এর মতে, ২০১৬ সালে ভারতে যত মৃত্যু ঘটেছিল, তার ২৮.২% ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ কার্ডিওভাসকুলার অসুখ। তবে এর মধ্যে কত শতাংশ মৃত্যুর কারণ আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, তা আর ভেঙে দেখানো হয়নি।
২০১২ সালে হায়দরাবাদের একটি হাসপাতালের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, মোট ১৬৯৯টি মৃত্যুর মধ্যে ১০.৩% ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ছিল আচমকা হওয়া কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। ২০১৪ সালের অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ভারতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ফলে কত জনের মৃত্যু হয় তার পরিসংখ্যান রাখা হয় না।
আরও পড়ুন: ২০১৮ সালের মার্কিন তরুণীর ছবিকে বলা হল শাহনাজ কউর গিল আইসিইউতে ভর্তি
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আসলে কী?
ডাঃ মেনন জানিয়েছেন, "হৃদপিণ্ডের নীচের প্রকোষ্ঠে ভেনটিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া বা ভেনটিকুলার ফাইব্রিলিশনের কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে।"
দুটির মধ্যে ফারাক বোঝাতে গিয়ে ডাঃ মেনন জানিয়েছেন যে, ট্যাকিকার্ডিয়া তখন হয় যখন হার্টবিট স্বাভাবিক গতিতে চলে না। আর ফাইব্রিলিশন হয় তখন, যখন হৃদপিণ্ড কাঁপতে থাকে, এবং রক্ত পাম্প করতে পারে না।
অন্য দিকে হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট 'চরিত্রে ইলেক্ট্রিক্যাল প্রকৃতির'। মুম্বইয়ের এশিয়ান হার্ট ইনস্টিটিউটে কর্মরত কার্র্ডিওলজিস্ট ডক্টর গেরেলা জানিয়েছেন, "আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের প্রধান কারণ অনিয়মিত হার্টবিট, যাকে অ্যারিদমিয়া বলা হয়।"
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ও হার্ট অ্যাটাকের মধ্যেকার ফারাকগুলি ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, অ্যাটাকের ক্ষেত্রে চিকিৎসার সুযোগ অনেক বেশি। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা হওয়া দরকার।
উপসর্গ ও ঝুঁকি
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হঠাৎ হতে পারে । কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে অনেক রোগীর ক্ষেত্রে খুব বুকে ব্যথা, মাথা ঘোরা বা ভার লাগা, চোয়াল, হাতে, পায়ে অস্বস্তি হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার মত উপসর্গ দেখা গেছে। ডক্টর মেনন জানিয়েছেন, "আগে থেকে সে রকম কোনও উপসর্গ থাকে না, মানুষ হঠাৎ আক্রান্ত হয়, তবে কিছু কিছু ঝুঁকি থেকে এই অসুখ বাড়তে পারে।"
বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন বহু কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের রোগীর ক্ষেত্রে আগে মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে সঙ্গে মানসিক চাপ, ডায়বেটিস, রক্তচাপের মত অসুখ ছিল বলে দেখা গেছে।
আগে বেশি বয়সকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মূল কারণ মনে করা হত। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনা এই ধারণা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে। ডাঃ গেরেলা জানিয়েছেন, "ম্প্রতি বহু অল্পবয়সি রোগীকে আমরা ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হতে এবং মারা যেতে দেখেছি।"
আরও পড়ুন: ভুয়ো বার্তা: থ্রম্বোসিস কোভিড মৃত্যুর প্রধান কারণ খুঁজে পেল সিঙ্গাপুর
সম্পূর্ণ সুস্থ্য মানুষও কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হতে পারেন
নিয়মিত ব্যায়াম করলে এবং স্বাস্থ্যকর ভাবে থাকলে যে কোনও অসুখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করা হয়। শুক্লা নিজের স্বাস্থ্যের নিয়মিত যত্ন নিতেন।
রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের রিহ্যাবিলিটেশন এবং স্পোর্টস মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশিস কন্ট্রাকটর জানিয়েছেন, "শরীরচর্চা করলে অনেক অসুখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, তা সত্যি; কিন্তু তাতে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবে না, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।"
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মুম্বই ম্যারাথনের মেডিকেল ডিরেক্টর কন্ট্রাক্টর ২০১৩ সালে তাঁর একটি ব্লগে লিখেছিলেন যে, এমনকি সম্পূর্ণ সুস্থ অংশগ্রহণকারীরাও এই লম্বা দৌড়ের পর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি লিখেছেন যে, বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে, "খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রমের ফলে ধমনীর মধ্যেকার ব্লকেজ ফেটে গিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। তার ফলে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। তাতে হার্ট বিট অস্বাভাবিক হয়ে যায়— যাকে পোশাকি ভাষায় ভেনটিকুলার ফাইব্রিলিশন বলা হয়। এতে অনেকেরই অসময়ে মৃত্যু হয়।"
তিনি আরও জানিয়েছেন যে, স্টাডি থেকে জানা গেছে এক্ষেত্রে ১০% মৃত্যুর কারণ শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়া, এবং শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।
সিপিআর এবং গোল্ডেন আওয়ার
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর যাঁরা জ্ঞান হারান, তাঁদের সাধারণত কার্ডিওপালমুনারি রিসাসসিটিশন (সিপি আর) দেওয়া হয়।
যখন কেউ একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তখন সিপিআর দেওয়া হয়। ডাঃ মেনন বলেন, "কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রেই সিপিআর দেওয়া হয়, হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে নয়।"
কী ভাবে সিপিআর দেওয়া হয়, তা বলতে গিয়ে ডাঃ গেরেলা জানান যে ৩:১ অনুপাত বজায় রাখা খুব জরুরি। তিনি বলেন, "বুকের পাঁজরায় তালু দিয়ে ধাক্কা দিয়ে শুরু করতে হয় এবং তিন বার চাপ দেওয়ার পর এক বার করে মুখে পাফ দিতে হয়। যত ক্ষণ না চিকিৎসা সহায়তা এসে পৌঁছোয়, তত ক্ষণ এই ভাবে চালিয়ে যেতে হয়।"
কিন্তু এখানে একটি সমস্যা আছে। হৃৎপিণ্ডকে ধাক্কা দিয়ে চালু করার ক্ষেত্রে প্রথম ৩-৫ মিনিট সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিফাইব্রেলেটর যা শক থেরাপি চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় তা দ্রুত জোগাড় করা দরকার। এই সংক্ষিপ্ত সময়সীমাকেই ডক্টর গেরেলা 'গোল্ডেন পিরিয়ড' বলেছেন।
ডাঃ মেনন অবশ্য এটিকে গোল্ডেন পিরিয়ড বা আওয়ার বা অন্য কোনও নাম দেওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি বলেন, "কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগীর কোনও গোল্ডেন আওয়ারের সুযোগ থাকে না। প্রথম কয়েক মিনিট বুকে এক নাগাড়ে চাপ দিতে থাকাটা জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রক্তের গতি ঠিক করার জন্য গোল্ডেন আওয়ার সময়ের দরকার হয়। আর এই ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডকে সঙ্গে সঙ্গে চালু করার চেষ্টা করা দরকার।"
সাবধানতা
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আটকানোর জন্য প্রথমে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা দরকার, আর সঙ্গে সব ধরনের কো-মর্বিডিটি থেকে মুক্ত থাকা দরকার। কোনও রকম সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দরকার।
ডাঃ কন্ট্রাকটর লিখেছেন, "যাঁরা খেলাধূলার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বছরে অন্তত এক বার করে স্ট্রেস টেস্ট, হৃৎপিণ্ডের কাজ করার ক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম, ২ডি ইকো টেস্ট যাতে হৃৎপিণ্ডের সবকটি ভালভ ঠিক মতো কাজ করছে কি না তা বোঝা যায় এবং পুরো সুগার, লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করা দরকার। এগুলি দিয়েই কতটা ঝুঁকি রয়েছে তা বোঝা যায়।"
ডক্টর গেরেলা জানান যে, প্রত্যেকেরই নিজের শরীর সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজিস্ট নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প এবং সচেতনতা শিবির চালান।
আরও পড়ুন: অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লার শেষ মুহূর্ত বলে ছড়াল সম্পর্কহীন পুরনো ভিডিও