ভাইরাল হওয়া একটি (Viral Message) মেসেজে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে রাজ্যগুলি রান্নার গ্যাস বা লিকুইফায়েড পেট্রলিয়াম গ্যাসের (LPG) দামের (price) উপর ৫৫% কর (Tax) বসায়।
পেট্রোল এবং ডিজেলের ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের মতো করে পরোক্ষ কর আদায় করতে পারে। কিন্তু এলপিজির ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। এলপিজি গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি-র আওতায় আসে। তার ফলে, গোটা দেশেই এলপিজি-র সিলিন্ডারের উপর ৫% হারে কর আদায় করা হয়।
ওই মেসেজে দাবি করা হয়েছে এলপিজি-র দামের করের একটা বড় অংশ রাজ্য পায়। তাই এলপিজি-র দাম বৃদ্ধির জন্য রাজ্য সরকারগুলিই দায়ী। সেই সঙ্গে ওই মেসেজে আরও দাবি করা হয়েছে এলপিজি-র উপর কেন্দ্রীয় সরকার মাত্র পাঁচ শতাংশ হারে কর আদায় করে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং হোয়্যাটসঅ্যাপে মেসেজটি শেয়ার করা হয়েছে। সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডারের দামের বিভিন্ন অংশের একটি ভুয়ো হিসাব পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ৮৬১.১৮ টাকা। একটি সিলিন্ডারের মূল দাম ৪৯৫ টাকা, এর উপর রাজ্য কর বসায় ২৯১ টাকা ৩৬ পয়সা, আর কেন্দ্র মাত্র ২৪ টাকা ৭৫ পয়সা। এই হিসাবের বাকি অংশে পরিবহণ খরচ এবং ডিলারের কমিশনের হিসাব দেওয়া হয়েছে।
নিচে এই দাবিটি দেওয়া হল।
"গ্যাস (এলপিজি) বেসিক দাম ..........৪৯৫.০০ টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের শুল্ক..২৪.৭৫ টাকা বহন খরচ ১০.০০ টাকা -------------------- মোট দাম...........৫২৯.৭৫ টাকা রাজ্য সরকারের শুল্ক....২৯১.৩৬ রাজ্য পরিবহন...১৫.০০ ডিলারের কমিশন. ৫.৫০ ছাড় (সাবসিডি) ..........১৯.৫৭ টাকা -------------------- গ্রাহক প্রদেয় মূল্য. ৮৬১.১৮ -------------------- কেন্দ্র সরকারের শুল্ক ৫%, রাজ্য সরকারের শুল্ক ৫৫% তাহলে দেখুন কোন সরকারের দোষ রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য।" |
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মেসেজটি ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: না, সাঁওতালি মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিকে অনিমা মুর্মু ২০২১ সালে প্রথম হননি
তথ্য যাচাই
১. এলপিজির দামের উপর সত্যিই কি রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার আলাদা আলদা কর বসায়?
এলপিজি-র বিষয়টি পেট্রোল ও ডিজেলের থেকে আলাদা। পেট্রোল ও ডিজেলের ক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার উভয়েই কর বসাতে পারে। কিন্তু এলপিজি-র ক্ষেত্রে অভিন্ন হারে জিএসটি প্রযোজ্য।
পেট্রোল এবং ডিজেলের দামের ক্ষেত্রে দুই ধরনের করের অংশ থাকে— একটা কেন্দ্র সরকার নির্ধারণ করে, এবং অন্যটা রাজ্য সরকার। এই দুই ধরনের কর পেট্রোল ও ডিজেলের মূল দামের সঙ্গে যোগ হয়।
- কেন্দ্রীয় সরকারের আদায় করা সেন্ট্রাল এক্সাইজ বা উৎপাদন শুল্কের হার বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোলের উপর ৩২ টাকা ৯০ পয়সা এবং ডিজেলের উপর ৩১ টাকা ৮০ পয়সা।
- কত শতাংশ স্টেট ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) যোগ হবে, তা বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে। কিছু রাজ্য এই দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাটের উপর আবার লিটারপিছু লেভি বা সেস আদায় করতে পারে। দিল্লির মতো কিছু জায়গায় ডিলারদের কমিশনও যোগ করা হয়। তবে অন্য অনেক রাজ্যে তা হয় না।
এলপিজি জিএসটির আওতায় আসে এবং বাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজি-র ক্ষেত্রে মূল দামের উপর ৫% হারে জিএসটি আদায় করা হয়। এর মধ্যে ২.৫% যায় রাজ্য সরকারের কাছে (এসজিএসটি), এবং ২.৫% যায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে (সিজিএসটি)।
পেট্রলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (পিপিএসি) প্রকাশিত তথ্য নীচে দেখতে পারেন।
পেট্রলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস পেট্রলিয়াম ও ন্যাচারাল গ্যাস মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি সংস্থা। এটি প্রায়ই ভারতীয় বাজারের তেল, পেট্রলিয়াম, গ্যাসের দামের উপর তথ্য প্রকাশ করে থাকে। এখানে এই বিষয়ে পড়তে পারেন। নীচে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন জ্বালানির উপর ধার্য জিএসটি, উৎপাদন শুল্ক ও আমদানি শুল্কের হার। এর আগে পিপিএসি প্রকাশিত বুম এ রকমই একটি মেসেজের তথ্য যাচাই করে। সেই মেসেজেও দাবি করা হয়েছিল পেট্রোলের দামের উপর যে কর থাকে, কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের কাছে তার বেশিটা যায়। তার ফলে, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য জন্য রাজ্য সরকারগুলিই দায়ী। বুম অনুসন্ধান করে দেখতে পায় যদিও এমন কিছু রাজ্য রয়েছে, যেখানে পেট্রোলের উপর কেন্দ্র ও রাজ্যের আদায় করা করের পরিমাণ কাছাকাছি, কিন্তু কোনও রাজ্যেই রাজ্য সরকারের আদায় করা করের পরিমাণ কেন্দ্রীয় করের চেয়ে বেশি নয়।
উপরের স্ক্রিনশটে পেট্রোল এবং ডিজেলের উপর ধার্য আমদানি শুল্কও দেখা যাবে। পিপিএসির প্রকাশিত রাজ্যের নির্ধারিত কর এবং অন্যান্য চার্জ এখানে (ডাউনলোড হবে) দেখতে পাবেন।
নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে আমাদের প্রতিবেদন পড়তে পারেন।
আরও পড়ুন: পেট্রোলের দামে রাজ্যের শুল্ক কি কেন্দ্রের চেয়ে বেশি? একটি তথ্য যাচাই
২. এলপিজির দাম কিভাবে নির্ধারিত হয়?
এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কী ভাবে নির্ধারিত হয়, পিপিএসি সেই তথ্যও প্রকাশ করে থাকে। এলপিজির দাম অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ থাকে ' ফ্রি অন বোর্ড' দাম, যা আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সম্পর্কিত।
পিপিএসি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, এলপিজি-র এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) হল সৌদি আারামকো-র বিউটেন ও প্রোপেনের গত এক মাসের কনট্র্যাক্ট প্রাইস-এর ভরযুক্ত গড়, যেখানে প্রথমটির ভর ৬০ শতাংশ, এবং দ্বিতীয়টির ৪০ শতাংশ। এ ছাড়াও এই গড়ের মধ্যে প্ল্যাটস গ্যাসওয়্যার প্রকাশিত গত এক মাসের দৈনিক প্রিমিয়াম/ডিসকাউন্ট-এর গড়ও অন্তর্ভুক্ত হয়।
এ ছাড়া আমদানি শুল্ক, পরিবহণ, কমিশন, জিএসটি, এবং সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার খরচ ইত্যাদিও এলপিজি-র দামের উপর প্রভাব ফেলে।
২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে এলপিজি-র দামের ব্রেকআপ নীচে দেখতে পাবেন।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের নভেম্বরে পিপিএসির প্রকাশিত একটি রেডি রেকনারে এই সব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, এলপিজি-র উপর ৫% হারে জিএসটি আদায় করা হয়।
এইসব তথ্য এখানে দেখতে পারেন।
৩. এলপিজি-র খুচরো বিক্রয়মূল্যের কত শতাংশ জিএসটি?
পিপিএসির রেডি রেকনার থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এলপিজির খুচরো বি্ক্রয়মূল্যের মধ্যে কত শতাংশ জিএসটি-র খাতে যায়।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসের রেডি রেকনারে পিপিএসির প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় নভেম্বরের ১ তারিখ দিল্লিতে এলপিজির ৫৯৪ টাকা দামের মধ্যে জিএসটি ছিল ২৮ টাকা ৩০ পয়সা— মোট দামের ৪.৮%। এই নথির ৬৭ পাতায় এই সংক্রান্ত তথ্য দেখতে পাবেন।
২০২০ সালের জুন মাসের রেডি রেকনারে পিপিএসির প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, জুনের ১ তারিখ দিল্লিতে এলপিজি-র দাম ৫৯৩ টাকার মধ্যে জিএসটি ছিল ২৮ টাকা ৩০ পয়সা— মোট দামের ৪.৮%। এই নথির ৬৩ পাতায় এই সংক্রান্ত তথ্য দেখতে পাবেন।
আরও পড়ুন: মৃত ভারতীয় সেনার দেহাবশেষ বলে ভুয়ো দাবিতে ফের জিইয়ে উঠল ডায়োরামা মডেল