১৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ (Rajnath Singh) দাবি করেন, হিন্দুত্বের আইকন বিনায়ক দামোদর সাভারকর (Vinayak Damodar Savarkar) নাকি মোহনদাস করমচন্দ গাঁধীর (Mahatma Gandhi) অনুরোধেই ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন (Savarkar Mercy Petition) জানিয়েছিলেন। কেউ-কেউ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই দাবিকে সমর্থন করলেও অনেকেই তাঁর দাবির মধ্যে ভুলত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন।
সাভারকর এবং গাঁধী বিষয়ে ইতিহাসের বিবরণ খতিয়ে দেখে বুম দেখেছে, রাজনাথের এই দাবি বিভ্রান্তিকর। এটা ঠিক যে কোনও একটা সময়ে গাঁধী সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয়কে আবেদন জানানোর কথা বলেছিলেন, কিন্তু রাজনাথ তাঁর বক্তৃতায় যে ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদনের উল্লেখ করেছেন, সে সময় গাঁধী ভারতে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়ই ছিলেন না। তা ছাড়া, এমন কোনও প্রমাণও নেই যে গাঁধী 'ক্ষমা-প্রার্থনার আবেদন' করার কথা বলেছিলেন।
আরও পড়ুন: নেতাজি নিজের মৃত্যুসংবাদ পড়ছেন? ছবিটি সম্পাদিত
রাজনাথ সিংহ একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন, যার নাম "বীর সাভারকর যিনি দেশভাগ রুখতে পারতেন"l বইটির লেখক উদয় মেহুরকর এবং চিরায়ু পণ্ডিত। রাজনাথ বলেন: "সাভারকরকে নিয়ে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছিল l বারংবার বলা হয়েছিল, জেল থেকে ছাড়া পেতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা করেছিলেন l মহাত্মা গাঁধীই সাভারকরকে এই আবেদন করতে বলেছিলেন l"
সাভারকর: ব্রিটিশের দালাল, নাকি রণনৈতিক জাতীয়তাবাদী
সাভারকরকে নিয়ে লেখা ও শেয়ার করা যে সব প্রবন্ধের দিকে রাজনাথ ইঙ্গিত করেছেন, সেগুলি আন্দামান সেলুলার জেলে আটক থাকার সময় সাভারকরের ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন বিষয়ক, যেখানে তিনি মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
এই প্রশ্নে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ব মতাদর্শের সমর্থক (যারা মনে করে সাভারকর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেতেই কারামুক্তির জন্য এই ক্ষমাভিক্ষা করেছিলেন এবং হিন্দুত্ব-বিরোধীদের মধ্যে (যারা সাভারকরের এই ক্ষমা-প্রার্থনা এবং গাঁধীর আততায়ী নাথুরাম গডসের সঙ্গে সাভারকরের নৈকট্যের মধ্যে স্বাধীনতা-সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকতার উপাদান দেখেছেন) বিতর্ক ও বাদানুবাদ এখনও চলছেই।
আরও পড়ুন: মহাত্মা গাঁধীর ছবির তুলনায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বড় ছবি বিজ্ঞাপনটি ভুয়ো
রাজনাথের এই বিবৃতি দুই ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব এবং বিক্রম সম্পতের মধ্যেও বিতর্ক উস্কে দিয়েছে, যাঁরা উভয়েই আবেদন দাখিল করার বিষয়ে ভাই নারায়ণ সাভারকরকে লেখা গাঁধীর চিঠির প্রেক্ষিত নিয়ে তর্ক জুড়েছেন।
গাঁধী ভারতে পৌঁছনর আগেই সাভারকর ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন করেন
১৯১১ সালের ১১ জুলাই নাসিকের জেলাশাসক এ এম টি জ্যাকসনকে হত্যার দায়ে বিনায়ক দামোদর ও নারায়ন সাভারকরকে সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরিত করা হয়।
২০১৯ সালে প্রকাশিত সম্পতের বই "বিস্মৃত অতীতের প্রতিধ্বনি—১৮৮৩-১৯২৪" অনুযায়ী ১৯১১ সালেই সেলুলার জেলে বসেই সাভারকর তাঁর ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন লেখেন। সম্পতের বক্তব্য, এই আবেদন নাকি ছিল "দিল্লি দরবারের শুভেচ্ছায় মার্জনা ও মুক্তি পেতে রাজনৈতিক বন্দিদের এক নিয়মমাফিক কৃত্য"l যাই হোক, সেই আবেদনটি প্রত্যাখ্যাত হয়।
দ্বিতীয় আবেদনটি সাভারকর দাখিল করেন ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর।
১৯৭৫ সালে ভারতীয় শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রকের সংস্কৃতি বিভাগের গেজেটিয়ার্স ইউনিট ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের একটি বই প্রকাশ করে, যার নাম "পেনাল সেটেলমেন্টস ইন আন্দামান" l সেই বইতেই সাভারকরের ১৯১৩ সালে লেখা সেই আবেদনের একটি প্রতিলিপি অন্তর্ভুক্ত হয়। এই চিঠিটাই ব্রিটিশের কাছে সাভারকরের ক্ষমা-ভিক্ষা এবং মুক্তি দিলে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার আশ্বাসের দলিলের উত্স।
বইতে ছাপা আবেদন অনুযায়ী সাভারকর লিখেছেন: "যদি সরকার দয়াপরবশ হয়ে আমায় মুক্তি দেন, তবে আমি সর্বতোভাবে সাংবিধানিক প্রগতি এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যে দৃঢভাবে অবিচল থাকব, যে-আনুগত্য ওই প্রগতির প্রাথমিক শর্ত"l
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সাংবিধানিক অর্থাত্ নিয়মতান্ত্রিক পথে তাঁর এই যাত্রা দেশে ও বিদেশে সেই সব বিপথগামী তরুণদের সেই পথে টেনে আনতে পারবে যারা পথনির্দেশের জন্য তাঁর দিকেই চেয়ে রয়েছে। "সরকার যে ভাবেই চাক, আমি তাদের সেবা করতে রাজি, কেননা যেহেতু আমি শুদ্ধ বিবেকেই এই মত-পরিবর্তন করছি, তাই আমার ভবিষ্যতের আচরণেও তা প্রতিফলিত হবে"l
আবেদনের একেবারে শেষে সাভারকর লিখলেন: "পিতৃপ্রতিম সরকারের দরজায় ছাড়া আর কোথায়ই বা এই বিপথগামী পুত্র আশ্রয় প্রার্থনা করবে?"
এই ধরনের ক্ষমা-ভিক্ষার সঙ্গে কি গাঁধীজির কোনও সম্পর্ক থাকা সম্ভব? মনে হয় নাl কেননা এই দুটি আবেদনই সাভারকর নিজের কলমেই লিখেছিলেন, গাঁধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গাঁধী ভারতে পদার্পণ করেন ১৯১৫ সালের ৯ জানুয়ারি, সাভারকর তাঁর দ্বিতীয় ক্ষমা-প্রার্থনার আবেদন জমা দেওয়ার প্রায় ২ মাস পরে।
নারায়ণরাও সাভারকরকে লেখা গাঁধীর চিঠি
টুইটারে বিতর্কের সময় বিক্রম সম্পত তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তি দিয়েছেন, ১৯২০ সালে নারায়ণরাও সাভারকরকে লেখা এক চিঠিতে গাঁধী সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয়কে আবেদন জানানোর পরামর্শ দেন। তাতে গাঁধী বলেন সাভারকররা যেন একটি ছোট চিঠিতে 'স্পষ্টভাবে বিনায়কের কৃতকর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে আবেদন করেন যে তাঁদের অপরাধটির চরিত্র একান্তভাবেই রাজনৈতিক'l
সম্পতের বইয়ে কিংবা মহাত্মা গাঁধীর সংগৃহীত রচনাবলীতে (১৯তম খণ্ড)কোথাও এ কথা উল্লেখ নেই যে, গাঁধী সাভারকর ভাইদের নির্দিষ্টভাবে ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষা করতে বলেছেন। বরং তিনি এও বলেছেন যে, তিনি তাঁর নিজের মতো করে বিষয়টি নিয়ে এগোবেন।
গাঁধীর এই চিঠির কয়েক মাস পর সাভারকর ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা-প্রার্থনা করে আরও একটি আবেদন পেশ করেন— তাঁর চতুর্থ আবেদন —যেখানে তিনি নিয়মতান্ত্রিক পথে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লেখেন- "ঘোষণাপত্রে বিজ্ঞাপিত এমন একটি সাম্রাজ্যের প্রতি আমার পূর্ণ আনুগত্য রয়েছে"l
এখানে উল্লেখ্য, নারায়ণরাও সাভারকরকে লেখা চিঠিতে গাঁধী একবারও ব্রিটিশ সরকারের কাছে সাভারকরকে ক্ষমা-ভিক্ষা করার পরামর্শ দেননি, বরং তাঁর অপরাধটা যে রাজনৈতিক এবং রাজবন্দি হিসাবেই যে তাঁর সঙ্গে আচরণ করা উচিত, সেই কথা আবেদনে তুলে ধরতে বলেছিলেন।
১৯২০ সালের ২৬ মে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় এক নিবন্ধে গাঁধী বরং সাভারকরের মতাদর্শ সম্পর্কে সংশয়মূলক অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি লেখেন: "সাভারকর ভাইরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উভয়েই জানাচ্ছে যে তারা ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে মুক্তি চায় না l উল্টে তারা মনে করে, ব্রিটিশদের সঙ্গে যুক্ত থেকেই ভারতের ভাগ্য শ্রেষ্ঠভাবে নির্ধারিত হতে পারে l ওদের মর্যাদা বা সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না, কিন্তু আমার মতে ওদের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ্যে যেভাবে বিবৃত হয়েছে, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করা উচিত l"
এর পর ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে গাঁধী সাভারকরদের মুক্তির জন্য সওয়াল করেন। "আমি তাই মনে করি, যদি ওই দুই ভাইকে মুক্তি দিলে রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হবে এমন নিঃসন্দেহ প্রমাণ না থাকে, তবে ওরা যে দীর্ঘ কাল দণ্ড ভোগ করেছে, (ওদের ওজনও অনেক কমে গেছে) এবং নিজেদের রাজনৈতিক মতামত ওরা প্রকাশ্যে জানিয়েও দিয়েছে, তাতে ভাইসরয় নিশ্চিতভাবেই ওদের মুক্তি দিতে বাধিত হবেন l"
শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালে সাভারকর ভাইরা দ্বীপান্তর থেকে মূল ভূখণ্ডের রত্নগিরির একটি জেলে স্থানান্তরিত হন এবং ১৯২৪ সালে তাঁদের এই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয় যে, তাঁরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন এবং জেলার বাইরে কোথাও যাবেন না।
যদিও গাঁধী সাভারকর ভাইদের আবেদন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তথাপি তাঁর পরামর্শেই সাভারকর ১৯২০ সালে ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন করেছিলেন বলে কোনও প্রমাণ নেইl শুধু তাই নয়, গাঁধী ভারতে পা দেওয়ার আগেই সাভারকর ব্রিটিশের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু-দুটি ক্ষমা-ভিক্ষার আবেদন জমাই দিয়ে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন: মহাত্মা গাঁধী এক মহিলার সঙ্গে হাসছেন? জিইয়ে উঠল সম্পাদিত ছবি