ব্যাপকাভাবে শেয়ার করা একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে মাইক্রোসফ্ট-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে (Bill Gates) কোভিড অতিমারির (COVID-19) থেকে তাঁর মুনাফা করার অভিযোগে প্রশ্ন করলে তিনি রেগে গিয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া থামিয়ে দেন।
বুম ভিডিওটি তদন্ত করে দেখেছে, যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভিডিওর দৃশ্যগুলি পরিবর্তিত করা হয়েছে এবং তার ওপর শব্দ জোড়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের নিশ্চিত করেছেন ব্রিটেনের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Reading) চলচ্চিত্র নির্মাণ বিভাগের সহ-অধ্যাপক এবং গবেষক ড. ডমিনিক লিজ (Dominic Lees)। তিনি আমাদের জানান, বেশ কয়েক ধরনের প্রযুক্তি কৌশল ব্যবহার করে এই ভুয়ো ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
যে ভিডিওটিতে এই সব কারিকুরি করা হয়েছে, আমরা সেই মূল ভিডিওটির সমগ্র অংশ দেখেছি—সেটির কোথাও না আছে অতিমারির সময় টিকা বেচে বিল গেটস-এর মুনাফা লোটার অভিযোগ, না আছে সেই অভিযোগ শুনে গেটস-এর ক্ষুব্ধ হয়ে সাক্ষাৎকারে ইতি টানার ঘটনা, যেমনটা নাকি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখানো হয়েছে।
১ মিনিট ৪১ সেকেন্ড দীর্ঘ ভাইরাল ভিডিওটিতে এবিসি নিউজ-এর সাংবাদিক সারা ফার্গুসনকে দেখা যাচ্ছে সফ্টওয়ার চুরি করা, চোরাই সফ্টওয়ার বিক্রি করার দায়ে গেটস-কে অভিযুক্ত করতে এবং ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো টিকা অতিমারির সময় বিক্রি করার অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে করা হচ্ছে।
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সহ অনেকেই টুইটারে এই ভুয়ো ভিডিওটি শেয়ার করেছেন এবং ভূষণ আবার ক্যাপশন দিয়েছেন—“দেখুন! কী ভাবে বিল গেটস কোভিড-এর অপরীক্ষিত এবং বিপজ্জনক টিকা প্রস্তুত করার অনবদ্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন! তিনি বিশ্বের এত বিপুল ক্ষতি সাধন করেছেন, অথচ এখনও এ দেশে তাঁকে মাথায় তুলে রাখা হয়েছে! সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রও তাঁকে গোয়েঙ্কা লেকচার দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে!”
পরে অবশ্য ভূষণ এই টুইট ডিলিট করে দেন। এর আগেও অবশ্য বুম কোভিড-১৯ নিয়ে প্রশান্ত ভূষণের ছড়ানো ভুয়ো খবরের টুইটের পর্দাফাঁস করেছে।
আর্কাইভ টুইটটি দেখুন এখানে।
অন্যান্য টুইটার ব্যবহারকারীও এই একই ভুয়ো ভিডিও বিভিন্ন ক্যাপশন সহ শেয়ার করেছে। এমনকী বুম এর হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬৫৮৮) এটি পাঠানো হয়েছে সত্যতা যাচাইয়ের অনুরোধ সহ।
টুইটটি দেখুন এখানে।
টুইটটি দেখুন এখানে।
ফেসবুকেও একই ভুয়ো দাবি সহ ভিডিওটি ছড়ানো হচ্ছে।
ফেসবুক পোস্টটি দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে বুম বুঝতে পারে যে এটিতে এমন কিছু অসঙ্গতি রয়েছে যাতে বোঝা যায়, এতে কারিকুরি করা হয়েছে—যেমন বিল গেটস ও সারা ফার্গুসনের উচ্চারিত শব্দগুলোর সঙ্গে তাঁদের ঠোঁটের নড়াচড়া মিলছে না।
আমরা ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ এবিসি নিউজে আপলোড করা মূল ভিডিওটিও দেখি। আমরা ১২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের সমগ্র সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি দেখি। তাতে সারা ফার্গুসন গেটস-কে পরিবেশের বদল, পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি, অতিমারীর সময় গেটস সম্পর্কে নানা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রশ্ন করেন। কোনও প্রসঙ্গেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের কোনও সাদৃশ্য পাইনি। গোটা সাক্ষাৎকার পর্বে সারা একবারের জন্যেও গেটস-কে সফ্টওয়ার চুরি করা, চোরাই সফ্টওয়ার বিক্রি করা কিংবা অতিমারির সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন কোভিড-১৯-এর টিকা বেচে মুনাফা কামানো বিষয়ে একটি প্রশ্নও করেননি। তা ছাড়া, ভাইরাল ভিডিওয় যেমন দাবি করা হয়েছে যে, গেটস রেগে গিয়ে সাক্ষাৎকারের মাঝপথে উঠে গেছেন, তেমন নাটকীয় কিছুও আদৌ ঘটেনি, গেটস অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে তাঁর ইন্টারভিউ সমাপ্ত করেছেন।
সেই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি নিচে দেখতে পারেন।
এ ছাড়াও বুম এই সব ভুয়ো ভিডিও সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ গবেষক ড. ডমিনিক লিজ-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করে। ড. লিজ ব্রিটেনের রিডিং ইউনিভার্সিটির চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি স্পষ্টই জানালেন—এই ভিডিওটি সম্পাদনা করে পরিবর্তিত করা হয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, কণ্ঠস্বর নকল করার মতো সস্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এ ধরনের ভুয়ো ভিডিও তৈরি করা যায় এবং গেটস ও তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তির বেলাতেও কণ্ঠস্বর নকল করার সেই প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের জালিয়াতি করার জন্য বাজারে নানা রকম সফটওয়্যারও পাওয়া যায়। তবে তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে সেই প্রকৌশলের প্রয়োগ অত্যন্ত স্থূলভাবে করা হয়েছে। যে কারণে কণ্ঠস্বর নকল করলেও (ভয়েস ক্লোনিং) মুখ ও ঠোঁটের নড়াচড়ার সঙ্গে উচ্চারিত শব্দগুলো মেলানো যায়নি (বিশেষ করে সাক্ষাৎকার নেওয়া ৫৯ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ৯ সেকেন্ড পর্যন্ত বলা শব্দগুলির বেলায়)।
এই ধরনের ভুয়ো অডিও বাজারে ছাড়ার সময় সচরাচর একটা অস্পষ্ট সঙ্গীতের সুর জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে উচ্চারিত কথাগুলির এবং উচ্চারণের ভঙ্গির দিক থেকে শ্রোতার মনোযোগ ওই গানের সুরের দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। গোটা ছবির অংশটা বেশ ছোটই থাকে, যার ওপরে বলা কথাগুলো সাব-টাইটেলের আকারে বসিয়ে দেওয়া হয়।
@bdti989— একজন টিকটকার যে এই ধরণের পোস্ট করে
জনৈক টুইটার ব্যবহারকারী তাঁর প্রতুত্যত্তরে জানিয়েছেন, ভাইরাল হওয়া এই টিকটক ভিডিওটি @bdti989- থেকে পোস্ট করা হয়েছে। আমরা এই টিকটক হ্যান্ডেলটিও শনাক্ত করেছি, যেখান থেকে ৮ মার্চ, ২০২৩ এই ভুয়ো ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে আপলোড করা হয়েছিল।
@bdti989 ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশন দেয়, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী ভাবে বিপজ্জনক হতে পারে!”
ওই একই টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নিয়েও ভুয়ো ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে।