সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত "IC 814: দ্য কান্দাহার হাইজ্যাক" (IC814: The Kandahar Hijack) মিনি-সিরিজের নির্মাতারা ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৮১৪ নম্বর ফ্লাইটের হাইজ্যাকারদের নাম পরিবর্তন করে "শঙ্কর" এবং "ভোলা" করেছেন দাবিটি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই দাবিটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের একাংশ ইঙ্গিত করেছেন প্রযোজকরা সন্ত্রাসবাদীদের মুসলিম (Muslim) পরিচয় গোপন করতে তাদের হিন্দু নাম দিয়েছেন।
বুম দেখে দাবিগুলি ভিত্তিহীন; তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ২০০০ সালের ৬ জানুয়ারীর বিবৃতি অনুসারে, "শঙ্কর" ও "ভোলা" নাম দুটি হাইজ্যাকিংয়ের সময় একে অপরকে সম্বোধন করার কোড নাম হিসাবে আদতেই ব্যবহার করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা, এই দুটি নাম ছাড়াও, চিফ, ডক্টর এবং বার্গারের মতো অন্যান্য কোড নামও তারা ব্যবহার করে। "আইসি ৮১৪" সিরিজে হাইজ্যাকারদের মুসলিম পরিচয় স্পষ্ট ভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে যা তাদের ধর্ম লুকানোর জন্য নাম পরিবর্তন করার দাবিটি নস্যাৎ করে।
"আইসি ৮১৪: দ্য কান্দাহার হাইজ্যাক" মিনি সিরিজটি নেটফ্লিক্সে ২৯ অগাস্ট, ২০২৪-এ মুক্তি পায়। সিরিজটিতে কাঠমান্ডু থেকে নয়াদিল্লি যাওয়ার জন্য ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করে তাকে তালিবান শাসিত এলাকা আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখানো হয়েছে। এই সিরিজটির বিষয়বস্তু হাইজ্যাক করা বিমানের ক্যাপ্টেন দেবী শরণ এবং সৃঞ্জয় চৌধুরীর "ফ্লাইট ইনটু ফিয়ার" বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
ভাইরাল দাবি
ফেসবুকে "IC 814: দ্য কান্দাহার হাইজ্যাক" সিরিজটির পোস্টার শেয়ার করে এক ব্যবহারকারী ক্যাপশনে দাবি করেছেন, "#অ্যান্টিহিন্দু_প্রোপাগান্ডা by দাউদউড..!! নেটফ্লিক্সে IC 814 দ্য কান্দাহার হাইজ্যাক (ওয়েব সিরিজ) মুক্তি পেয়েছে.. ভারতের ওই বিমান আসলে যারা ছিনতাই যারা করেছিলো তাদের নাম....,#মোহাম্মদ_ইব্রাহিম_আখতার, #মোহাম্মদ_শহীদ_আখতার, #মোহাম্মদ_সানি_আহমেদ, #মোহাম্মদ_জহুর_মিস্ত্রি, #মোহাম্মদ_শাকির কিন্তু, কান্দাহার বিমান হাইজ্যাক নিয়ে তৈরি ওয়েব সিরিজে সন্ত্রাসীদের নাম #ভোলা ও #শঙ্কর দেখানো হয়েছে।.."
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
জনপ্রিয় ডানপন্থী এক্স ব্যবহারকারী ঋষি বাগরি এবং দ্য জয়পুর ডায়ালগসও হাইজ্যাকারদের আসল নামগুলি শেয়ার করে ইঙ্গিত করেছে সিরিজের নির্মাতারা মুসলিম নামগুলি পরিবর্তন করে হিন্দু নাম "ভোলা" ও "শঙ্কর" করেছেন।
উপরের টুইটগুলির আর্কাইভ দেখতে এখানে, এখানে এবং এখানে ক্লিক করুন।
বিজেপির আইটি প্রধান অমিত মালব্য একটি এক্স পোস্টের মাধ্যমে ইংরেজিতে দাবি করেছেন, "আইসি-৮১৪-এর হাইজ্যাকাররা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী ছিল, যারা তাদের মুসলিম পরিচয় লুকানোর জন্য ছদ্মনাম নিয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা অনুভব সিনহা তাদের অমুসলিম নামকে ব্যবহার করে তাদের অপরাধমূলক অভিপ্রায়কে বৈধতা দিয়েছেন। ফলাফল? কয়েক দশক পরে মানুষ ভাববে হিন্দুরা আইসি-৮১৪ হাইজ্যাক করে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের, যারা সবাই মুসলিম, তাদের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বামপন্থীদের পরিকল্পনা কার্যকর হয়েছে। এটাই চলচ্চিত্রের শক্তি, যা কমিউনিস্টরা ৭০-এর দশক থেকে আগ্রাসীভাবে ব্যবহার করে আসছে। হয়তো তারও আগে। এটি দীর্ঘমেয়াদে ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কেবল দুর্বল/প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, বরং রক্তপাতের জন্য দায়ী যে ধর্মীয় গোষ্ঠী তার থেকে দোষ সরিয়ে দেবে।"
পোস্টটির আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই: নামগুলো কি পরিবর্তন করা হয়েছে?
বুম ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ হাইজ্যাক করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সরকারী তথ্য অনুসন্ধান করতে সম্পর্কিত কিওয়ার্ড সার্চ করে।
আমরা বিদেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে ২০০০ সালের ৬ জানুয়ারী প্রকাশিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতি পাই যেখানে ঘটনাটির বিশদ বিবরণ ছিল।
সরকারি সূত্রে পাওয়া প্রমাণ
বিবৃতি অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদীরা একে অপরকে সম্বোধন করতে চিফ, ডাক্তার, বার্গার, ভোলা এবং শঙ্কর ছদ্ম নাম ব্যবহার করেছিল। তাদের আসল নাম ছিল সানি আহমেদ কাজী, শাকির, মিস্ত্রি জহুর ইব্রাহিম, শহীদ আখতার সৈয়দ এবং ইব্রাহিম আখতার।
এর থেকে বোঝা যায় সিরিজটির নির্মাতারা ইচ্ছাকৃতভাবে সন্ত্রাসবাদীদের নাম পরিবর্তন করেননি, বরং তাদের ব্যবহৃত প্রকৃত ছদ্ম নামগুলি ব্যবহার করে হাইজ্যাকের ঘটনাটির চিত্রায়ণ করেছেন।
লেখক, গীতিকার এবং সাংবাদিক নীলেশ মিশ্র এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিক থাকাকালীন আইসি ৮১৪ বিমানে হাইজ্যাকের সময় সেই বিমানে ছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে "173 Hours in Captivity" বইটি লেখেন।
মিশ্র একটি এক্সে পোস্টে লেখেন "শঙ্কর" এবং "ভোলা" নামগুলির সাথে "বার্গার", "ডাক্তার" এবং "চিফ" বলে একে অপরকে সম্বোধন করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা এবং যাত্রীরাও তাদের ওই নামে উল্লেখ করেছিল।
সিরিজে সন্ত্রাসবাদীদের চিত্রায়ণ
উপরুন্তু, বুম সিরিজটি দেখার পর লক্ষ্য করে প্রথম পর্ব থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় সন্ত্রাসবাদীরা মুসলিম ছিল। উদাহরণস্বরূপ, একটি দৃশ্যে একজন সন্ত্রাসবাদীকে একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলতে দেখা যায়, যার মাথায় মুসলিমদের মতো টুপি এবং দাড়ি দেখা যায়- যেগুলি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে সে একজন মুসলিম। এর থেকে বোঝা যায় সিরিজের নির্মাতারা সন্ত্রাসবাদীদের মুসলিম পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেছেন ভাইরাল দাবিটি ভুয়ো।