কংগ্রেস দলের সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর (Sonia Gandhi) একজন বিচারপতির সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, এই বিচারপতিই হলেন সুপ্রিম কোর্টের সেই বিচারক পার্দিওয়ালা, যিনি পয়গম্বর মহম্মদে সম্পর্কে বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এই ছবি শেয়ার করা পোস্টগুলিতে আরও ভুয়ো দাবি তোলা হয়েছে যে, এই পার্দিওয়ালাই নাকি ১৯৮০-র দশকে গুজরাত বিধানসভায় কংগ্রেস দলের এমএলএ ছিলেন এবং রাজ্য বিধানসভার স্পিকারও হয়েছিলেন।
বুম দেখে এই দাবিগুলি ভুয়ো। ছবিতে যাঁর সঙ্গে সনিয়া গাঁধীকে দেখা যাচ্ছে, তিনি মোটেই পার্দিওয়ালা নন, বরং সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কে জি বালকৃষ্ণন। বুম আরও দেখে পার্দিওয়ালা নন, তাঁর পিতা কাওয়াসজি পার্দিওয়ালাই একদা কংগ্রেস দলের বিধায়ক ও রাজ্য বিধানসভার স্পিকারের পদে আসীন ছিলেন।
গত ১ জুলাই, ২০২২ পয়গম্বরের বিরুদ্ধে তাঁর মন্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন রাজ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে আসার যে আবেদন বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মা করেছিলেন, তার উপর রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি পার্দিওয়ালা এবং সূর্য কান্ত তাঁকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন এবং দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে এককভাবে তাঁর ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন, যে-উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত রাজস্থানের উদয়পুরে এক দর্জির হত্যাকাণ্ডে পরিণাম পায়।
বুম ফেসবুকে এই ছবিটি ছড়াতে দেখেছে যার ক্যাপশন হিসেবে লেখা হয়, "এই হলেন সেই বিচারপতি পার্দিওয়ালা, যিনি রিয়াজ-এর হাতের ছোরায় নিহতের মৃত্যুর জন্যেও নূপুর শর্মাকেই দায়ী করেছেন! এই মান্যবরকে চিনতে পারছেন, যিনি ৮০-র দশকে কংগ্রেসের এমএলএ ছিলেন এবং সপ্তম গুজরাত বিধানসভায় স্পিকারও হয়েছিলেন? কেন ভারতীয় বিচারবিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস হচ্ছে বুঝতে পারছেন?"
এই পোস্টের হিন্দি ক্যাপশনের খোঁজ করতে গিয়ে আমরা ফেসবুকে ও টুইটারে পোস্টটিকে ভাইরাল হতে দেখেছি যাতে একই ভুয়ো দাবিসহ কিছু পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ভারতের ঘটনা বলে ছড়াল তাইল্যান্ডে শিশুকে কুকুর আক্রমণের ভিডিও
তথ্য যাচাই
বুম প্রথমে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ছবিটির কোনও হদিশ পায়নি। শেষে একটি ভাইরাল পোস্টের মন্তব্য অংশে দেখি ছবিটিকে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বালকৃষ্ণনের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর আমরা বালকৃষ্ণন এবং সনিয়া গাঁধীর ছবি খুঁজতে-খুঁজতে গেট্টি ইমেজেস-এর একটি ছবিতে আটকে যাই, যাতে উভয়কেই ভাইরাল পোস্টে দেখানো একই পোশাকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
ছবিটির ক্যাপশনে লেখা, "ভারতের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি কে জি বালকৃষ্ণনকে অভিনন্দিত করছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, যা দাঁড়িয়ে দেখছেন ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান। ১৪ জানুয়ারি ২০০৭-এ নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে এক অনুষ্ঠানেই তাঁর শপথ গ্রহণ হয়।"
এর পর আমরা বিচারপতি পার্দিওয়ালার কংগ্রেস এমএলএ ও স্পিকার হওয়ার গুজবটির খোঁজ নিতে থাকি।
সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পার্দিওয়ালার যে প্রোফাইল নথিভুক্ত রয়েছে, তাতে লেখা, "১৯৮০-র দশকে তিনি ছাত্র ছিলেন, আইনের স্নাতক ডিগ্রি পেতে পড়াশোনা করছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ভালসাদ-এর জে পি আর্টস কলেজ থেকে স্নাতক হন, ১৯৮৮ সালে ভালসাদ-এরই কে এম ল' কলেজ থেকে আইনের স্নাতক হন।"
ওই প্রোফাইলে তাঁর পিতা বুর্জোর কাওয়াসজি পার্দিওয়ালার কথাও উল্লেখিত রয়েছে, যিনি নিজেও আইনজীবী ছিলেন এবং সপ্তম গুজরাট বিধানসভায় স্পিকার হয়েছিলেন। এই সূত্র থেকেই আমরা বুঝতে পারি, বিচারপতি পারদিওয়ালাকে তাঁর পিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কারণেই ভাইরাল পোস্টের ভুয়ো গুজব প্রচারিত হয়ে চলেছে।
আমরা বুর্জোর কাওয়াসজি পার্দিওয়ালা যে সব পদে ছিলেন, তার পুরো তালিকা সংগ্রহ করি। ভারত সরকারের ওয়েবসাইট থেকে গুজরাট বিধানসভার সব স্পিকার সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করি। তাতে দেখি বুর্জোরজি পার্দিওয়ালার নাম অষ্টম বিধানসভার স্পিকার হিসাবে রয়েছে।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত বুর্জোরজি পার্দিওয়ালার একটি মরণোত্তর শ্রদ্ধাঞ্জলিও আমরা দেখতে পাই, যেখানে তাঁকে ভালসাদ থেকে নির্বাচিত এক কংগ্রেস এমএলএ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
এরপর আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট ঘেঁটে ভালসাদ বিধানসভা কেন্দ্রের সব সাবেক এমএলএ-র তালিকা সংগ্রহ করি।
সেই তালিকাতেও ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভালসাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস এমএলএ হিসাবে বুর্জোরজি কাওয়াসজি পার্দিওয়ালার নাম জ্বলজ্বল করছে।
এর থেকেই প্রমাণিত হয়, ভাইরাল করা পোস্টের দাবি যাঁর সম্পর্কে করা হয়েছে, তিনি মোটেই সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বিচারপতি পার্দিওয়ালা নন, বরং তাঁর পিতা বুর্জোরজি কাওয়াসজি পার্দিওয়ালা, যিনি কংগ্রেস এমএলএ এবং গুজরাত বিধানসভার স্পিকারও ছিলেন, কিন্তু কোনও মতেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নন।
আরও পড়ুন: অর্ণব গোস্বামীর নাচের ভিডিও উদ্ধব ঠাকরের ইস্তফার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়