ভিডিও যাচাই না করে দিঘা-তমলুক (Digha Tamluk) রেল লাইনের ফিসপ্লেটের (fishplate) খুলে নেওয়ার ঘটনা বলে ভুয়ো খবর (media misreporting) প্রচার করল বাংলা গণমাধ্যমের একাংশ। দিঘায় আরপিএফ-এর (RPF) সঙ্গে জনৈক ব্যক্তির বচসার পর ওই ব্যক্তি এই কাণ্ড ঘটায় বলে দাবি করা হয় গণমাধ্যমের বুলোটিন ও প্রতিবেদনে।
বুমকে দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্য কুমার চৌধুরি জানান, “আমরা রেল লাইন সম্পূর্ণ দেখেছি। এরকম কিছু ঘটেনি।" গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
রিপাবলিক বাংলা ২৫ মার্চ ২০২৩ বুধবার প্রচারিত তাদের বুলেটিনের শিরোনাম লেখে, “দিঘা-তমলুক রেললাইনে খোলা ফিসপ্লেটের নাট”। রিপাবলিক বাংলার প্রতিবেদক জানান, জগবন্ধু হাইস্কুলের কাছে টি ডি ৮৭/নাইন, টি ডি ডি৮৭/১০-এই পোলের অন্তর্বর্তী জায়গায় ওই নাট খুলতে দেখে এলাকার গ্রামবাসীরা। ওই ভিডিওতে ৪ টি খোলা নাটের ভিডিও দেখায় রিপাবলিক বাংলা। ভিডিওটি দেখুন এখানে। আর্কাইভ করা আছে এখানে।
রিপাবলিক বাংলা পরবর্তী বুলেটিনে দাবি করে তাদের খবরের জেরে তড়িঘড়ি মেরামতি হয় ওই লাইনে। কিন্তু তাদের খবরে উল্লেখ নেই মেরামতির দৃশ্য। পুরনো দৃশ্যই বারংবার দেখা হয় নতুন বুলেটিনে যার শিরোনাম, “রিপাবলিক বাংলার খবরের জের, দিঘা- তমলুক রুটে রেললাইনের খোলা ফিসপ্লেট মেরামতি”।
বুলেটিনটি দেখুন এখানে। আর্কাইভ করা আছে এখানে।
বুলেটিনগুলিতে গ্রামবাসীদের সূত্র উল্লেখ করে দাবি করা হয়, আরপিএফ এক ব্যক্তিকে মারধর করে তার প্রতিশোধে নিতেই ওই ব্যক্তি রেল লাইনের নাটগুলি খুলে নেন। উল্লেখ্য, রিপাবলিকের দুটি বুলেটিনেই নেই কোনও প্রত্যক্ষ্যদর্শী, রেলের আধিকারিক বা আরপিএফ-এর বয়ান।
রিপাবলিক বাংলা অরেকটি বুলেটিনে দক্ষিণ পূর্ব রেলের জন সংযোগ আধিকারিক আদিত্য কুমার চৌধুরির বক্তব্য সম্প্রচার করে। তিনি বলেন বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে। (২ মিনিট ৪ সেকেন্ড সময়ের পরে) বুলেটিনটি দেখুন এখানে। আর্কাইভ করা আছে এখানে।
এই সময়, হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা ও অমৃতবাজার প্রভৃতি গণমাধ্যম তাদের ওয়েবসাইটেও বিষয়টি নিয়ে একইভাবে প্রতিবদেন প্রকাশ করে।
এই সময় গণমাধ্যমকে অবশ্য দক্ষিণ পূর্ব রেলের জন সংযোগ আধিকারিক আদিত্য কুমার চৌধুরি জানান, “এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনও তথ্য সামনে আসেনি। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হবে।” তাছাড়া প্রতিবেদনে আর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী বা আরপিএফ-এর বক্তব্যের উল্লেখ নেই।
বুলেটিন সম্প্রচার করে এই সময় ও নিউজ ১৮ বাংলা। এই বুলেটিনের ঘটনাস্থলের দৃশ্যও বস্তুত একই। বলা বাহুল্য একই দৃষ্টিকোন থেকে তোলা হয় ক্যামেরার দৃশ্য।
এই দুই গণমাধ্যমও তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট রেল স্টেশনের আধিকারিক বা জিআরপিএফ এর বক্তব্য। এই সময় ও নিউজ ১৮ বাংলার প্রতিবেদন আর্কাইভ করা আছে এখানে ও এখানে।
তথ্য যাচাই
রেলের কর্তাব্যক্তিরা ঘটনা অস্বীকার করলেন
বুমের তরফে দিঘা জিআরপি থানার ওসি সুখেন দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, তিনি আমাদের বলেন, “ওখানে কোনও ফিসপ্লেট লাগানো নেই। জিএরপি-এর সঙ্গে কোনও ব্যক্তির বচসা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “ভিডিওতে দেখানো হয়েছে প্যান্ড্রোল ক্লিপ। লাইনে কাজ সবসময় চলে। রেলের গতিতে তা আলগা হয়ে গেলে মেরামত করে নেওয়া নেয় লাইন ম্যান”।
দূর্ঘটনার পরিকল্পনা বলে ছড়ানো ভুয়ো খবর নাকোচ করা হয় জিআরপির তরফে। দীঘা আরপিএফের কন্ট্রোল রুমের তরফে বচসার ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়েছে।
বুমের তরফে দিঘার স্টেশন ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ফিসপ্লেট বা নাট খুলে নেওয়ার দাবির সত্যতা জানতে চাইলে তিনি আমাদের বলেন, “ঘটনার কোনও সত্যতা নেই”।
কিভাবে গুজব ছড়ালো সে ব্যাপারে তাঁর কোনও ধারণা নেই বলে জানান আমাদের।
বুম দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্য কুমার চৌধুরির সঙ্গে রবিবার যোগাযোগ করলে তিনি জানান, “আমরা রেল লাইন সম্পূর্ণ দেখেছি। এরকম কিছু ঘটেনি। আরপিএফ ও রেলের আধিকারিকদের (পিডাব্লুআই স্টাফ) যুগ্ম রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায়নি।”
গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত ভিডিওটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে উষ্মা প্রকাশ করেন আদিত্য। আদিত্য আরও বলেন, “আমি ওই ব্যক্তিকে ঘটনাস্থল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমাকে কিছুই উত্তর দেয়নি। তারা যে কোনও একটা ঘটনার ভিডিও সম্পচার করছে।”
বুম ফেসবুকে কিওয়ার্ড সার্চ করে স্থানীয় গণমাধ্যম ‘দিঘা লাইভ’-পেজে দিঘার স্টেশন ইনচার্জ এসকে মহাপাত্রকে ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে দেখে। ‘দিঘা লাইভ’ ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় একাধিক গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা ওই জায়গায় এই ধরণের কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন।
দেখুন দিঘা লাইভের রিপোর্ট।
ফিসপ্লেট ও প্যান্ড্রোল ক্লিপ কি?
ফিসপ্লেট হল দুটি লাইনের সংযোগ স্থলে বিশেষ জোড়ার পাত। অন্যদিকে প্যান্ড্রোল ক্লিপ হল বিশেষ ধাতুজ ক্লিপ যার সাহায্যে রেলের লাইন আটকে থাকে কংক্রিটের স্লিপারের সঙ্গে।
১৯৬৬ সালের রেলের নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ব্যতীত কেউ ফিসপ্লেট বা প্যান্ড্রোল ক্লিপ খুলতে বা বদলাতে পারেন না।