ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (India's First Prime Minister) জওহরলাল নেহরুর (Jawaharlal Nehru) লন্ডনে London) পৌঁছানোর একটি পুরনো ভিডিও শেয়ার করে বলা হচ্ছে, তাঁকে "লন্ডনের নাগরিক'' (Citizen of London) হিসাবে নথিভুক্ত করা হচ্ছে, যার বিনিময়ে নাকি নেহরু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের (Queen Elizabeth II) প্রতি আনুগত্যের শপথ উচ্চারণ করছেন। বেশ কয়েকটি পোস্টে ভিডিওটি শেয়ার করে নেহরুর ভারতীয় নাগরিকত্বের মর্যাদা নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে এবং কেউ-কেউ এমনকী এই নথিভুক্তির পর তাঁকে ব্রিটেনের নাগরিক বলেও বর্ণনা করেছেন।
বুম যাচাই করে দেখে, দাবিটিবি ভ্রান্তিকর এবং প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো; এ কথা ঠিক যে, নেহরুকে "ফ্রিডম অফ দ্য সিটি অফ লন্ডন" সম্মানে ভূষিত করে "লন্ডনের নাগরিক" রূপে বরণ করা হয় কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটাই সাম্মানিক, এ জন্য নেহরু ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জনের কোনও সুযোগ-সুবিধা যেমন পাননি, তেমনই তাঁকে তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব বর্জনও করতে হয়নি। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, কোনও শহর কোনও ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারে না, সেই এক্তিয়ার কেবল কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই রয়েছে।
উপরন্তু নেহরু ইংল্যান্ডের রানির প্রতি দায়বদ্ধ থাকার একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন বটে, কিন্তু সেটা ছিল একান্তভাবেই প্রতীকী ঘোষণা, যা ঐতিহ্যের অন্তর্গত এবং তার সঙ্গে কোনও দায় যুক্ত ছিল না।
বুম ফেসবুক এবং টুইটারেও একই ভিডিও বিভিন্ন দাবি ও ব্যাখ্যা সহ শেয়ার হতে দেখেছে। অধিকাংশ পোস্টেরই ক্যাপশনে লেখা, "কেউ কি জানো যে নেহরু ১৯৫৬ সালে লন্ডনের নাগরিক হিসাবে নথিভুক্ত হয়েছিলেন এবং রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ ঘোষণা করেছিলেন?"
পোস্টটি দেখুন এখানে।
একই ভিডিও ব্যবহার করে অন্য কেউ-কেউ নেহরুর ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েই সংশয় ব্যক্ত করেছেন।
টুইটটির আর্কাইভ দেখতে ক্লিক করুন এখানে।
কেউ-কেউ আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে দাবি করেছেন এর মাধ্যমে নেহরু ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে নিয়েছেন।
পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
এই পোস্টগুলি ফেসবুক ও টুইটারে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে।
আরও পড়ুন: না, ভিডিওটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে খালিজ টাইমসের রিপোর্ট নয়
তথ্য যাচাই
বুম ভাইরাল ভিডিওটি মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে, তাতে "ব্রিটিশ পাথে" নামে যে লোগো বা প্রতীক রয়েছে, ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের স্মারক ভিডিওগুলিতে সেই প্রতীক ব্যবহারের ঐতিহ্য রয়েছে।
এই সূত্র ধরে আমরা ব্রিটিশ পাথের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে নেহরু বিষয়ক পুরনো ভিডিও খুঁজতে থাকি এবং ভাইরাল ভিডিওর একটি বড় সংস্করন খুঁজে পাই। ভিডিওটি ইংরেজি "দুইজন মহান প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডন সম্মানিত করছে (১৯৫৬)" (London Honours Two Great Premiers 1956) শিরোনামে আপলোড করা হয়।
ভিডিওটিতে জওহরলাল নেহরু এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিডনি হল্যান্ডকে "ফ্রিডম অফ দ্য সিটি অফ লন্ডন" উপাধিতে ভূষিত করার এবং লন্ডনের নাগরিক হিসাবে নথিভুক্ত করার কথা আলোচিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানটি লন্ডনের প্রাক্তন চেম্বারলেইন স্যার আরভিং ব্লানচার্ড গেন দ্বারা তত্ত্বাবধান করা হয়েছিল এবং নেহেরু বা হল্যান্ড কাউকেই শপথ নিতে দেখা যায়নি।
ফ্রিডম অফ দ্য সিটি-একটি প্রাচীন ঐতিহ্য
লন্ডন শহরের ওয়েবসাইট অনুসারে ফ্রিডম অফ দ্য সিটি ১২৩৭ সাল থেকে চলে আসা লন্ডনের এক প্রাচীন ঐতিহ্য।
মধ্য যুগে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুর সম্পত্তি নয় এমন শ্রমিক-কারিগরদের ফ্রিম্যান বা স্বাধীন বলে গণ্য করা হতো। ১৮৩৫ সাল থেকে এই স্বাধীনতা সেই সব শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে থাকে, যারা কোনও গিল্ডের সদস্য নয় এবং যারা ব্যবসাপত্র করে বা কারিগরি প্রযুক্তির সাহায্যে নিজস্ব স্বাধীন রোজগার করার অধিকারী।
পুরনো ভিডিওটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ভাষ্যকারও এই সব তথ্যই সামনে নিয়ে এলেন। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে—"অতীত কালে যারাই শহরের চৌহদ্দির মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য করতে চাইত, তাদের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা অপরিহার্য ছিল। এখন অবশ্য এই উপাধিটা বিশিষ্ট ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বেলাতেই প্রযুক্ত হয়।"
অতীতের কার্যকারণগুলো এখন অদৃশ্য, কিন্তু তবু প্রথা হিসাবে এই প্রাচীন ঐতিহ্য আজও চলে আসছে। এ থেকে বোঝা যায়, 'ফ্রিম্যান' হিসাবে নেহরুর উপাধি বা 'লন্ডনের নাগরিক' হিসাবে তাঁর অভিধা নিছকই একটি সাম্মানিক ভূষণ, যার জন্য তাঁর উপর ব্রিটেনের প্রতি কোনও দায় বর্তায় না।
তা ছাড়া, জাতীয়তা তো কোনও শহর বা নগর প্রশাসন আরোপ করতে পারে না, সেই অধিকার রয়েছে কেবল সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
রানির প্রতি আনুগত্যের শপথ?
লন্ডন শহরের ওয়েবসাইট অনুসারে এই ঘোষণাপত্রে বলতে হয়: "আমি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, লন্ডনের মেয়রের প্রতি অনুগত থাকব এবং যে সব নিয়ম-কানুন ও রীতি-রেওয়াজ রয়েছে তা মেনে চলব, শহরকে উপদ্রবমুক্ত রাখতে সাহায্য করব, রানির শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকব। আমার কাছ থেকে শহরের ঐতিহ্য ও প্রথার কোনও হানি যাতে না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকব।"
যারা ব্রিটিশ নাগরিক নন কিংবা ব্রিটিশ কমনওয়েল্থ-ভুক্ত তারা শপথবাক্যে 'আওয়ার সভারেইন লেডি' না বলে 'হার ম্যাজেস্টি'ও বলতে পারবেন।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর ফুটেজে নেহরুকে দেখা যাচ্ছে একটি দলিলে স্বাক্ষর করার পর একটি বক্তৃতা দিতে। সেই বক্তৃতায় নেহরু তাঁর যৌবনকালে লন্ডনে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছেন, ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। তাঁকে রানির প্রতি কোনও মৌখিক শপথ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। যার অর্থ তাঁর স্বাক্ষরিত নথিতেই হয়তো সে কথা ছিল।
এ ছাড়া আমরা সিটি অফ লন্ডন কর্পোরেশন প্রকাশিত একটি ভিডিও পেয়েছি, যাতে "ফ্রিডম অফ দ্য সিটি" শিরোনামটির ওপর এবং তা দেওয়ার পদ্ধতির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
ভিডিওটিতে চেম্বারলেনের কোর্টের ক্রেইগ মারে জানাচ্ছেন—ইদানীং কালে এই অনুষ্ঠানটি নিতান্তই প্রতীকী হয়ে গেছে। ভিডিওতে অন্যান্যদের স্বাক্ষর করা ঘোষণাপত্রের ছবিও রয়েছে, যাতে স্পষ্ট হয়, মৌখিকভাবে শপথ উচ্চারণের রেওয়াজ আর নেই।
আর যেহেতু শিরোপা বা অভিধাটি নিজেও প্রতীকী এবং তার সঙ্গে কোনও দায়বদ্ধতা জুড়ে নেই, তাই স্বাক্ষরিত ঘোষণাপত্রেরও প্রতীকী মূল্য ছাড়া অন্য তাত্পর্য নেই।
সিটি অফ লন্ডনের কাছে আমরা আরও ব্যাখ্যা চেয়েছি। তা পাওয়া গেলেই প্রতিবেদনটি সংস্করণ করে নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: ভুয়ো দাবি: রাষ্ট্রসংঘ বলল বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা