৪টি ভিডিও ক্লিপকে সোশাল মিডিয়ায় এক জায়গায় সংগ্রহ করে ক্যাপশন দিয়ে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সদ্য-সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের (West Bengal Assembly Election) পরে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়া হিংসার (Violence) পাল্টা প্রতিহিংসা নিতে হিন্দুরা (Hindu) ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
বুম দেখেছে, ৪টি ভিডিওর মধ্যে ৩টিই পুরনো এবং সাম্প্রতিক হিংসার সঙ্গে এগুলির কোনও সম্পর্ক নেই।
২ মে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজ্য জুড়ে ব্যাপক হিংসা ঘটতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি শান্তির জন্য রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন করেন এবং নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের অঙ্কও ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে উপদ্রুত এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করতে প্রতিনিধিদলও পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় কিছু ছবি ও ভিডিও ভুয়ো ক্যাপশন সহ প্রচার করে ভোট-পরবর্তী হিংসার সঙ্গে সে সব জুড়ে দেওয়া হয়। ভুয়ো খবরের রমরমার মধ্যেই ভাইরাল হওয়া ভিডিও নতুন সংযোজন ঘটায়।
এক মিনিট দীর্ঘ এই ভাইরাল ভিডিওতে কিছু লোক পরস্পরের উপর হামলা চালাচ্ছে বলে দেখানো হতে থাকে। ভিডিওতে একাধিক মারপিটের ঘটনা একসঙ্গে করে সঙ্গে একটা হিন্দি গানও জুড়ে দেওয়া হয়, আর বিপথগামী ক্যাপশনে লেখা হয়: "পশ্চিমবঙ্গে এ বার হিন্দুরা প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।"
(হিন্দিতে মূল বয়ান: बंगाल के हिंदुओं ने पलटवार करना शुरू कर दिया है)
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নীচে দেখুন আর তার আর্কাইভ বয়ান দেখুন এখানে।
বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ এবং টুইটার হ্যান্ডেলেও ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে।
আরও পড়ুন: ২০১৯ সালে দিল্লিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের ধর্নার ছবি ছড়াল সাম্প্রতিক বলে
তথ্য যাচাই
বুম ভিডিওটিকে কয়েকটি মূল ফ্রেমে ভেঙে নিয়ে খোঁজ-খবর করে দেখেছে, বিভিন্ন পুরনো ক্লিপকে এক জায়গায় জড়ো করে এটি বানানো।
প্রথম ক্লিপ
২০১৮ সালের নভেম্বরে ইউটিউবে ছাড়া একটি ভিডিওর কিছু অংশ নিয়ে এই ক্লিপটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে: "যে মুহূর্তে হিন্দুরা তরোয়াল বের করলো, জেহাদি মুসলমানরা পালানোর পথ পেল না।"
(হিন্দিতে মূল বয়ান: हिंदुओं ने तलवार क्या निकाल ली जिहादी मुसलमान भाग निकले)
নীচের ভিডিওটি দেখুন
ভিডিওটিতে দু দল লোককে দেখা যাচ্ছে-- এক দলের হাতে তরোয়াল ও ত্রিশূল, অন্য দলের মাথায় মুসলমানি টুপি এবং হাতে তরবারি। এক দল পুলিশ অফিসারকেও দেখা যাচ্ছে বিবদমান উভয় পক্ষকেই শান্ত করার চেষ্টা করতে।
আশেপাশে বেশ কিছু লোককেও দেখা যাচ্ছে (সম্ভবত আলোকচিত্রী) যাঁরা জনতার ছবি তুলছেন। আমরা খুব মন দিয়ে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, কয়েকজন পাগড়ি পরা লোকও সেখানে রয়েছে।
এর পর আমরা 'পাঞ্জাবে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ' এই শব্দগুলি বসিয়ে ইউটিউবে খুঁজে দেখলাম, এটি ২০১৭ সালে আপলোড হওয়া একটি ভিডিও, যার ক্যাপশন হলো— ফাগোয়ারায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধ।
বুম ২০১৬ সালে সংঘটিত শিবসেনা সমর্থক বনাম মুসলিমদের একটি সংঘর্ষের খবরও খুঁজে পেয়েছে, যার প্রতিবেদন ২০১৬ সালের ২৩ জুলাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ছাপা হয়েছিল। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে ওই প্রতিবেদনের কিছু স্ক্রিনশটও ব্যবহার করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে জম্মু-কাশ্মীরে অমরনাথ যাত্রায় বিঘ্ন ঘটাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়, যার আগে শিবসেনার নেতারা স্থানীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন।
রিপোর্টে জানানো হয়, মুসলিমরা শিবসেনার বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভ-মিছিলও করেন। শিবসেনাও তাদের রাজ্য সহ-সভাপতি ইন্দ্রজিত কারওয়ালের নেতৃত্বে প্রতিবাদ-মিছিল করে পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেl নাইওয়ানওয়ালা চকে দুই পক্ষের মিছিল মুখোমুখি হয়।
দ্বিতীয় ক্লিপ
এই ক্লিপটির তল্লাশি করে আমরা ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ ইন্ডিয়া টিভির ইউ-টিউবে আপলোড করা একটি ভিডিওর সন্ধান পাই। এই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল, "হিন্দু মুসলাম নিয়ে রাজনীতি ও সংঘাত হোলিতেও এতটুকু কমেনি।"
ইন্ডিয়া টিভি-র রিপোর্ট অনুসারে ঘটনাটি হরিয়ানা রাজ্যের গুরুগ্রামের।
(হিন্দিতে মূল বয়ান:Holi के त्यौहार पर भी नहीं थमी Hindu-Muslim पर सियासत और झगड़ा !)
ভিডিওটিতে হিংসার দৃশ্য রয়েছে, তাই সতর্কভাবে দেখবেন।
২০১৯ সালের ২৪ মার্চ দ্য কুইন্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ঘটনাটি গুরুগ্রামের ভোঁড়সি জেলার হোলির দিনের সন্ধ্যার ঘটনা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে হোলির দিন কিছু মুসলিম তাঁদের আত্মীয়ের বাড়িতে এলে ২০-২৫ জন যুবক লাঠি-সোঁটা, রড নিয়ে তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে হামলা চালায়। রিপোর্টে এই হামলার জন্য মাত্র একজনকে গ্রেফতার করার খবর জানানো হয়।
গুরুগ্রামের ধমসপুর গ্রামে একটি মুসলিম পরিবারে কিছু আত্মীয় সফর করতে এলে ওই পরিবারের লোক ও অতিথিদের উপরেও লাঠি-রড নিয়ে নৃশংস আক্রমণ চালায় ২০-২৫ জন লোক, বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে, হোলির দিন সন্ধ্যায়।
তৃতীয় ক্লিপ
এই ক্লিপে দেখা দৃশ্যটির একটি দীর্ঘতর বয়ান বুম দেখতে পায় "মসজিদে পাথর ছোঁড়া" শব্দগুলি বসিয়ে খোঁজ চালিয়ে, সেটি ২০১৮ সালে আপলোড হয়েছিল।
ফেসবুকেই এটি আপলোড হয়েছিল, যার ক্যাপশন ছিল: "এই কুকুরগুলো মসজিদে পাথর ছুঁড়ছে l এরা মানবতার শত্রু l"
(হিন্দিতে মূল বয়ান: यह कुत्ते मस्जिद पर पत्थर फेंक रहे हैं यह हिंदुस्तान के दुश्मन हैं इंसानियत के दुश्मन है)
ঘটনাটি কোথায় ঘটছে, ফেসবুক পোস্টে তার উল্লেখ নেইl কিন্তু আমরা নেপথ্যে হিন্দিতে কথা হচ্ছে শুনতে পেয়েছি। তা ছাড়া ভিডিওতে যে সব দোকান দেখা যাচ্ছে, সেগুলির সাইনবোর্ডও হিন্দিতে লেখা।
বুম এটা নিশ্চিত করতে পারেনি যে হামলার ঘটনাটি ঠিক কোথায় ঘটছে এবং কেন ঘটছে। তবে একটা ব্যাপারে বুম নিশ্চিত যে, এটি কোনও সাম্প্রতিক ঘটনা নয়, ২০১৮ সালের পুরনো ভিডিও।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওর মধ্যে একটিকে আমরা কোনওভাবে শনাক্ত করতে পারিনি।
আরও পড়ুন: বিকৃত ভিডিওর দাবি কোয়ারান্টিন ভেঙে জি-৭ বৈঠক করেছেন এস জয়শঙ্কর