তিনটি ছবির একটি কোলাজ ভাইরাল হয়েছে, যাতে দাবি করা হয়েছে যে, ছবিগুলি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi), রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু (Darupai Murmu) এবং মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের (Eknath Shinde) তরুণ বয়সের ছবি। দাবিটি ভুয়ো (false claims)।
বুম যাচাই করে দেখে যে ছবিগুলি ভিন্ন ব্যক্তির— তাদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর কোনও সম্পর্ক নেই।
ছবিটি বিবিধ ক্যাপশনের সঙ্গে শেয়ার করা হচ্ছে। হিন্দিতে লেখা তেমনই একটি ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "নীচের চারটি ছবি দেখে আশ্চর্য হতে হয় যে, ভাগ্যের খেলা কী বিচিত্র। ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. রাষ্ট্রপতি, ৩. উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, ৪. মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী।
(মূল হিন্দিতে ক্যাপশন: नीचे चार फोटो को देखकर आश्चर्य होता है कि भाग्य का खेल भी गजब है 1-प्रधानमंत्री 2-राष्ट्रपति 3-उत्तर प्रदेश मुख्यमंत्री 4-महाराष्ट्र मुख्यमंत्री)
পোস্টগুলিতে চারটি ছবি রয়েছে, যাতে (ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে) কন্নড় ভাষায় ক্যাপশন দেওয়া আছে— ১. মোদী, ২. মুর্মু, ৩. যোগী, ৪. একনাথ।
ছবিগুলিতে দাবি করা হয়েছে যে, তরুণ মোদী মেঝে ঝাড় দিচ্ছেন, তরুণী মুর্মু একটি পুরনো শাড়ি পরেছেন, এবং তরুণ একনাথ শিন্ডে একটি অটোরিকশার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে যে, কোলাজে ব্যবহৃত যোগী আদিত্যনাথের ছবিটি সত্যিই তাঁর। কিন্তু বাকি ছবিগুলি ভুয়ো। সেগুলিতে যাঁদের দেখা যাচ্ছে, তাঁরা তরুণ বয়সের প্রধানমন্ত্রী মোদী, রাষ্ট্রপতি মুর্মু বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে নন।
আমরা প্রতিটি ছবি নিয়েই রিভার্স ইমেজ সার্চ করি, এবং তাতে যে তথ্যগুলি উঠে আসে, তা এই রকম।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর মেঝে মোছার ছবি
যে ছবিটি ব্যবহার করে দাবি করা হয়েছে যে, তাতে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে মেঝে ঝাড় দিতে দেখা যাচ্ছে, সেটি একটি বহুব্যবহৃত ভুয়ো ছবি। বুমসহ আরও একাধিক তথ্য যাচাইকারী সংস্থা এই ছবিটিকে বারে বারেই ভুয়ো প্রমাণ করেছে।
এর আগের একটি তথ্য যাচাইয়ে বুম দেখেছিল যে, এই ছবিটিতে এক জন সাফাইকর্মীর মুখের উপর মোদীর মুখটি মর্ফ করে বসানো হয়েছে। আসল ছবিটি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর (এপি) এক চিত্রসাংবাদিক ১৯৪৬ সালের ২ জুন তুলেছিলেন।
এপি-র আর্কাইভে আসল ছবিটি আছে। সেখানে চিত্রগ্রাহক হিসাবে পুলিৎজার-জয়ী ম্যাক্স ডিফসর-এর নাম রয়েছে। ছবিটি ১৯৪৬ সালে তোলা। তার ক্যাপশনে লেখা রয়েছে, "ভারতের এক 'অস্পৃশ্য' জাতির মানুষের হাতে ঝাঁটা, যা দিয়ে তিনি রাস্তা, বাগান ও বাড়িঘর সাফ করেন। ২ জুন, ১৯৪৬। এই অস্পৃশ্য মানুষরা, গাঁধী যাঁদের হরিজন (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করেন, দেশের সব 'অপরিষ্কার' কাজ করেন। গাঁধী বারে বারেই বলেছেন যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অস্পৃশ্যতার নামে যে পাপ করেছে, দেশে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসন তার উপযুক্ত শাস্তি।"
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ছবি
যে ছবিটিকে দ্রৌপদী মুর্মুর অল্প বয়সের ছবি বলে দাবি করা হয়েছে, তাতে পুরনো শাড়ি পরা, এবং মাথার চুল ঢাকা এক মহিলা শ্রমিককে দেখা যাচ্ছে। আমরা ছবিটিকে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখতে পাই যে, ইনি দ্রৌপদী মুর্মু নন, উপরবেড়ায় এক হাসপাতালের নিকাশি কর্মী। শৈশবে রাষ্ট্রপতি এখানে লেখাপড়া করেছিলেন।
ছবিটিকে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করায় আমরা ২৩ জুলাই ২০২২ তারিখে প্রকাশিত নিউজ১৮-র একটি সংবাদ প্রতিবেদনের সন্ধান পাই, যাতে ভাইরাল হওয়া ছবিটিই ব্যবহৃত হয়েছিল। বিজেপি দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে এনডিএ-র প্রার্থী ঘোষণা করার পর মুর্মুর প্রতিবেশী, গ্রামের বাসিন্দা, এবং তিনি উপরবেড়া নামে যে জায়গাটিতে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন, সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি লেখা হয়।
নিউজ১৮-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ভাইরাল ছবিটিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি "সুকুমার টুডু, উপরবেড়ার একটি হাসপাতালে সাফাই কর্মচারী হিসাবে কাজ করেন।" প্রতিবেদনটিতে এই একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন অসুবিধা নিয়ে টুডুর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর অটোরিকশার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি
ভুয়ো দাবিসমেত করা টুইটির একটি উত্তর আমরা খুঁজে পাই, যেখানে বলা হয়েছে যে, ছবিতে যে ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে, তিনি বাবা কাম্বলে। তিনি মহারাষ্ট্র রিকশা পঞ্চায়েতের প্রতিষ্ঠাতা। ছবির ব্যক্তি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে নন। এই সূত্র ধরে আমরা ফেসবুকে মারাঠি হরফে বাবা কাম্বলে লিখে সার্চ করি, এবং দেখতে পাই যে, মহারাষ্ট্র রিকশা পঞ্চায়েত, পুণে-র পেজে ২২ জুলাই ২০২২ তারিখে ছবিটি আপলোড করা হয়েছে। পেজে ছবিটি মারাঠি ভাষায় লেখা যে ক্যাপশনের সঙ্গে আপলোড করা হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, এটি রিকশা পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট কাম্বলের ১৯৯৭ সালের ছবি, যাতে তাঁকে পিম্পরি রাতনানি রিকশা স্ট্যান্ডে তাঁর অটোরিকশার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
পিম্পরি হল জোড়া শহর পিম্পরি-চিঞ্চওয়াডের একটি, মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার অন্তর্গত।
বিভিন্ন মারাঠি নিউজ চ্যানেলে এই ছবিটির সত্য যাচাই করে জানানো হয়েছে যে, এটি শিন্ডের ছবি নয়, আমরা দেখতে পাই যে, এই ফেসবুক পেজে তার উল্লেখ রয়েছে। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে শিন্ডে অল্প কিছু দিনের জন্য মুম্বইয়ের নিকটবর্তী জেলা থানে-তে অটোরিকশা চালকের কাজ করেছেন।
আমরা মারাঠি ভাষায় লেখা এবিপি মাঝা-র একটি সংবাদ প্রতিবেদনেরও সন্ধান পাই, যাতে প্রতিবেদক এই ভাইরাল ছবিটির বিষয়ে কাম্বলের সঙ্গে কথা বলেন। কাম্বলে জানান, "একনাথ শিন্ডে এক সময় অটোরিকশা চালক ছিলেন, এখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। এটি রাজ্যের সব অটোরিকশা চালকের জন্যই একটি গর্বের মুহূর্ত। সেই আবেগেই কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ছবি পোস্ট করেন, যা মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডের ছবি বলে দাবি করে ভাইরাল হয়ে যায়। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে প্রমাণ হয় যে, ছবিটি আমার। এ বিষয়ে অনেকেই আমায় ফোনও করেছেন। আমার মনে হয়, আমার তরুণ বয়সে যেমন দাড়ি ছিল, মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডেরও তেমন দাড়ি থাকাতেই এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।"
তরুণ যোগী আদিত্যনাথের ছবি
বুম যাচাই করে দেখে যে, এই ছবিটি আসল, এবং এতে তরুণ বয়সের আদিত্যনাথকেই দেখা যাচ্ছে। তাঁর সম্বন্ধে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে এই ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে। আদিত্যনাথের জীবন নিয়ে করা অমর উজালার একটি ফটো ফিচার থেকে জানা যাচ্ছে যে, ছবিটি ১৯৯৪ সালের। তিনি সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, এবং অজয় বিস্ত হিসাবে তাঁর পরিচয় ত্যাগ করার পর এই ছবিটি তোলা হয়েছিল।
আরও পডুন: বিভ্রান্তি সহ ছড়াল তেলঙ্গানায় বিজেপি ও টিআরএস কর্মীদের সংঘর্ষ দৃশ্য