জেএনইউ (JNU) থেকে সংগ্রহ করা একটি ইস্তেহার (leaflet) অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির (Smriti Irani) ২০১৬ সালের একটি লোকসভায় দেওয়া বক্তৃতার ভিডিও কাটছাঁট করে ভাইরাল করে দাবি করা হচ্ছে তিনি নাকি দেবী দুর্গাকে (Durga) অসম্মান করেছিলেন!
বুম দেখে ইরানি আসলে একটি ইস্তেহার থেকেই একাংশ লোকসভায় তাঁর ২০১৬ সালের ভাষণে উদ্ধৃত করেছিলেন। অভিযোগ তুলে দাবি করেন জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি ছড়ানো হয়।
দেবী কালী বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র এবং সাংসদ মহুয়া মৈত্রের একটি বিতর্কিত মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই ইরানির ওই বক্তৃতার ভিডিওটি ভাইরাল করা হয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত একটি কনক্লেভে মহুয়া মৈত্র (Mohua Moitra) বলেছিলেন, দেশের নানা প্রান্তে কালীকে পূজো করার সময় মদ ও মাংস নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি আসলে লীনা মণিমেকালাই (Leena Manimekalai) নির্মিত একটি তথ্যচিত্রের বিষয়ে মন্তব্য করছিলেন। তাঁর পোস্টারে কালীর সাজে সজ্জিত এক শিল্পীকে সিগারেট ফুঁকতে দেখা যাচ্ছিল এবং যার পিছনে ছিল বিকল্প যৌনতার (LGBTIQ+) অধিকার বিষয়ক একটি পোস্টার। সেই থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মণিমেকালাই এবং মহুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। ইতিমধ্যেই অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস জানিয়ে দেয়, মহুয়ার বক্তব্য দলের বক্তব্য নয়।
৩৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটিতে স্মৃতি ইরানিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, "দুর্গাপুজো হলো সব থেকে বিতর্কিত এবং জাতিবিদ্বেষী উত্সব, যেখানে এক সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী দেবী দুর্গাকে মহিষাসুর নাম্নী এক কৃষ্ণাঙ্গ ভূমিপুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখানো হয়। মহিষাসুর ছিলেন এক সাহসী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যোদ্ধা যাঁকে ছল-চাতুরি করে আর্যরা বিবাহে প্রলুব্ধ করে। তারা দুর্গা নাম্নী এক যৌনকর্মীকেও ভাড়া করে, যে মহিষাসুরকে বিয়েতে প্রলুব্ধ করে এবং নয়টি রাত (নবরাত্রি) মহিষাসুরের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা যাপন করার পর তাঁকে হত্যা করে।"
ফেসবুকে এই পোস্টটি শেয়ার করে লেখা হয়েছে, "মা দুর্গা সম্পর্কে সে দিনের স্মৃতি ইরানির এই কদর্য মন্তব্যকে ভুলে গেলে চলবে না বন্ধুগণ!কখন কোন অবস্থায় মা দুর্গা সম্পর্কে কুমন্তব্য করা হয়েছে, তা স্মৃতি ইরানি ছাড়া কেউ জানে না।"
তথ্য যাচাই
বুম 'স্মৃতি ইরানি-দুর্গা-মহিষাসুর', এই শব্দগুলি বসিয়ে খোঁজখবর করে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন পেয়েছে, যাতে ওই ভিডিওটির পূর্ণঙ্গ বয়ান রয়েছে।
গুজরাতের একটি স্থানীয় সংবাদ-চ্যানেল দেশি গুজরাত এইচডি নামের একটি চ্যানেলে ইউটউবে ইরানির ৪৯ মিনিটের ওই দীর্ঘ বক্তৃতার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও আপলোড করে।
সেই সময় ইরানি ছিলেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী। তিনি তাঁর বক্তৃতার প্রসঙ্গ হিসাবে জেএনইউ থেকে প্রাপ্ত একটি লিফলেটের উল্লেখ করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মহিষাসুর শহিদ দিবস উদযাপন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটা নোটিশ জারি করেছিলেন।
ভিডিওটির ৩০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের সময় থেকে ইরানিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, "মহাশয়া, ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই নোটিশটি জারি করা হয়... ৯ তারিখ রাত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিভিন্ন স্থানে স্বাক্ষর সহ এই লিফলেটটি সেঁটে দেওয়া হয়। এতে লেখা ছিল, মহিষাসুর শহিদ দিবস উপলক্ষে একটি জনসভাও বানচাল করে দেওয়া হয়। এখন আমি জানতে চাই... মহাশয়া, এই মহিষাসুর শহিদ দিবস ব্যাপারটা কী? আমাদের সরকারকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে এবং আজকে আমি সৌগত রায় এবং সুগত বসুর মতো বাক-স্বাধীনতার দুই প্রবল প্রবক্তাদের এখানে দেখছি না। এই বিষয় নিয়ে আমি আজ এখানে বিশদে আলোচনা করব, যা নিয়ে ওঁরা কলকাতার পথে-ঘাটে কথা বলতে পারেন। ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর জেএনইউ-র তফশিলি-আদিবাসী-অনগ্রসর-সংখ্যালঘু ছাত্ররা এই বিবৃতি দিয়েছিল, ওঁরা কেউ কি এটার নিন্দা করেছেন?"
সে সময় লোকসভার স্পিকার পদে ছিলেন সুমিত্রা মহাজন।
এর পর ৩১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে ইরানিকে বলতে শোনা যায়, "এইটা পাঠ করার জন্যে আমার ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন! দুর্গা পূজা হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত এবং জাতিবিদ্বেষী উৎসব। যেখানে এক পরমাসুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী দুর্গা কৃষ্ণকায় মহিষাসুরকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে বলে দেখানো হয়। মহিষাসুর এক পরম সাহসী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতা, যাঁকে আর্যরা ছলে-কৌশলে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে। এ জন্য তারা দুর্গা নাম্নী এক যৌনকর্মীকে ভাড়া করে, যে মহিষাসুরকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে এবং ৯ রাত্রি তার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করার পর তাকে ঘুমের মধ্যে হত্যা করে। আপনারা বাক-স্বাধীনতার কথা বলেন! কে এই বিষয়টা নিয়ে কলকাতার রাস্তায়-গলিতে আলোচনায় নামবেন আমি জানতে চাই!"
২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই বক্তৃতার ভিডিওই বিজেপির সরকারি ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হয়। বিজেপির যাচাই করা হ্যান্ডেলের ফেসবুক পোস্টেও এটি আপলোড করা হয়।
২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমস দুর্গা ও মহিষাসুরকে নিয়ে স্মৃতি ইরানির বিবৃতি বিষয়ে তাঁর নিজের ব্যাখ্যাও প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনের একটি অংশে লেখা হয়, "বিতর্কের জবাবে আমি লিফলেটটা পড়েছিলাম কারণ, আমাকে সত্যটা ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছিল। খুবই বেদনার সঙ্গে আমি ওই লিফলেটটা পাঠ করি। আমি নিজেও তো একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। আমি মা দুর্গার আরাধিকাও বটে! এই সবই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া দলিলপত্র।" রাজ্যসভায় বলতে থাকেন ইরানি, যখন বিরোধী পক্ষ তাঁর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। সেসময় রাজ্যসভায় কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা ইরানির কাছে তাঁর এই ধর্মদ্রোহাত্মক বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবিও তোলেন।
ওই ২০১৬ সালেরই ২৬ ফেব্রুয়ারি দ্য কুইন্ট এবং এবিপি নিউজ একই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বুম অবশ্য নিজে থেকে দুর্গা ও মহিষাসুরকে নিয়ে রচিত ওই ইস্তাহারের সত্যতা যাচাই করতে সক্ষম হয়নি।
আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপে সরকার নজরদারি চালাচ্ছে দাবিতে ফের ছড়াল পুরনো গুজব