সম্প্রতি গোমাংস মন্দিরে ফেলে উত্তরপ্রদেশে (Uttar Pradesh) হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা (Communal Riot) লাগানোর চক্রান্ত করার তিনজন হিন্দু যুবককে আটক করা হয়েছে দাবিতে এক গ্রাফিক ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
গ্রাফিকটিতে কিছু যুবকের মাথা নীচু করে হেঁটে যাওয়ার এক ছবি ব্যবহার করে তাদের উত্তরপ্রদেশে দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্তে ধৃত তিন হিন্দু যুবক বলে উল্লেখ করা হয়।
বুম দেখে ভাইরাল ছবিতে আদতে ২০২২ সালে পাকিস্তানের মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্ট দলের সমর্থকদের সেদেশে আটক হওয়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গতঃ, সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কয়েকবার উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন মন্দিরে মাংস পাওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায় সেরাজ্যে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উত্তরপ্রদেশের মালদহ চাট্টি এলাকার এক হনুমান মন্দিরে মাংস পাওয়ার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ালে চারজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় বলে জানায় সিকান্দরপুর পুলিশ।
ভাইরাল সেই গ্রাফিকটিতে লেখা হয়, "উত্তর প্রদেশের বিন্নোর-এ দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্ত তিন কুইন্টাল গো মাংস সহ ধরা পড়ল তিন হিন্দু যুবক। এই গোমাংস মন্দিরে ফেলে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্ত করা হয়েছিল।"
এক ফেসবুক ব্যবহারকারী সেই গ্রাফিক "পুলিশের হাতে ধরা পড়লো দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রকারীরা" দাবিতে পোস্ট করেন।
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে ও তার আর্কাইভ দেখতে এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম ভাইরাল ছবির বিষয়ে জানতে তাকে গুগলে রিভার্স সার্চ করে ১৮ অগাস্ট ২০২২ তারিখের এক রেডিট পোস্ট খুঁজে পায়। পাকিস্তান নামক সাব-রেডিটে পোস্ট করা ওই ছবির ক্যাপশনে ধৃত ব্যক্তিদের ১৪ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে সেদেশের এমকিউএম রাজনৈতিক দলের পুরোনো গানের সাথে নাচ করায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়।
এছাড়াও ওই পোস্টে বলা হয়, ছবিতে তিনজন ১৪-১৭ বছর বয়সী ছেলে দেখতে পাওয়া যায় যাদের বিরুদ্ধে 'গদ্দারি' তথা বিশ্বাসঘাতকতার মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
আমরা লক্ষ্য করি, ছবিটি পোস্ট করা রেডিট ব্যবহারকারীকে অন্য একজন ব্যবহারকারী তার তথ্যের উৎস্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ১৭ অগাস্ট, ২০২২ তারিখ মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্ট তথা এমকিউএমের এক্স হ্যান্ডেল থেকে করা ভিডিও পোস্টের লিংক দেন।
ভিডিওটি পোস্ট করে লেখা উর্দু ক্যাপশনটির বঙ্গানুবাদ, "হায়দরাবাদে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে এমকিউএম-এর সমাবেশে গ্রেফতার করা যুবকদের আদালতে তোলা হয়। আদালত পুলিশের রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে তাদের জুডিশিয়াল রিমান্ডে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়"।
পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে ও তার আর্কাইভ দেখতে এখানে।
আমরা দেখতে পাই ভিডিওতে থাকা দৃশ্যের সাথে ভাইরাল ছবির দৃশ্য মিলে যায়। নীচে সেই তুলনা দেখতে পাওয়া যাবে।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আটক হন মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্ট নেতাকর্মীরা
সম্পর্কিত কীওয়ার্ড সার্চ করে আমরা এবিষয়ে পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডনের প্রকাশিত ১৮ অগাস্ট, ২০২২ তারিখের এক প্রতিবেদনও খুঁজে পাই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি থানায় দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৭ অগাস্ট দেওয়ানি জজ ও বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট-২ মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্ট-লন্ডনের (এমকিউএম-এল) নয় নেতাকর্মীকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠান।
রিপোর্টে লেখা হয়, এমকিউএম-লন্ডনের কর্মীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং তাদের নেতা আলতাফ হোসেনের পক্ষে স্লোগান দিয়েছিলেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, "যাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন আলি হামজা আরাইন, মোহাম্মদ ফয়জান, জামিল আহমেদ, মোহাম্মদ নাভিদ কোরেশি, মোহাম্মদ শাহরুখ এবং মোহাম্মদ শাহবাজ কুরেশি। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ ফুরকান, ১৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ ফারহান আরাইন এবং ১৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ আজিজ আরাইনও রয়েছে।"
মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তবে তাদের মধ্যে নয়জনকে তখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় বলে উল্লেখ করা হয় ওই রিপোর্টে।
আলতাফ হুসেন ও তার দল মুত্তাহিদা কোয়ামি মুভমেন্টের ইতিহাস
বিবিসির প্রকাশিত ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারত থেকে যাওয়া উর্দুভাষীদের নিয়ে ১৯৮৪ সালে আলতাফ হুসেন তার দল গঠন করেন। পরে কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন করাচি রাজনীতির অন্যতম চরিত্র। ১৯৯২ সালে এক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর দেশ ছাড়েন আলতাফ। নব্বইয়ের দশকেই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ করেন এবং পরে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পান।
২০১৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল দুটি ভাগে ভেঙ্গে যায় - এর মধ্যে একটি হয় আলতাফ হুসেনের নেতৃত্বাধীন লন্ডন-ভিত্তিক এমকিউএম-এল এবং অন্যটি তার বিরোধী অংশ, পাকিস্তান-ভিত্তিক এমকিউএম-পি।