বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) ভাঙা মূর্তির একটি পুরনো ছবি ও তাঁর মূর্তি স্থাপনের এক পৃথক ভিডিও বিভ্রান্তিকর দাবি সহ ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্যবহারকারীরা দাবি করেছেন দৃশ্যগুলি বাংলাদেশে (Bangladesh) চলা অশান্ত পরিস্থিতির যেখানে একদল লোককে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ধ্বংস করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় স্থানেই পালিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন তাঁর মূর্তির অবমাননার এই দৃশ্যগুলি ভাইরাল হয়েছে। বুম দেখে দৃশ্যগুলি ২০২৩ সালের যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্মিত রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্যের স্থাপন এবং পরবর্তীতে মূর্তিটির অন্তর্ধানের দৃশ্য দেখা যায়। ভাস্কর্যটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ঢাকায় রাজু মেমোরিয়াল ভাস্কর্যের কাছে পুনরায় স্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশে চলা সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনায় সেদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙার খবরের পাশাপাশি এই দৃশ্যগুলিও ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিবাদের পর ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালালে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার সহ-সভাপতি তরুণজ্যোতি তিওয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তির চারপাশে ভিড়ের একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখেন, "কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করার ছিল কি? লজ্জা ... এরা নাকি আবার নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করে।"
পোস্টটি দেখুন এখানে এবং আর্কাইভ দেখুন এখানে।
সুদর্শন বাংলা ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশন হিসাবে লেখে, "কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশের এই কার্যক্রম... লজ্জা হওয়া উচিত...।"
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের ভাঙা মূর্তির ছবি শেয়ার করে একজন ব্যবহারকারী ক্যাপশনে লেখেন, "কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করার ছিল কি? লজ্জা ... এরা নাকি আবার নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করে।"
পোস্টটি দেখুন এখানে, আর্কাইভ দেখুন এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে বাংলাদেশের বর্তমান বিশৃঙ্খলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির ছবি বা ভিডিওর কোনও যোগসূত্র নেই।
আমরা দেখি ঘটনাটি ২০২৩ সালের যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মূর্তি নিখোঁজ হয়। ভাস্কর্যটির অবশিষ্টাংশ পরে ঢাকার শিক্ষার্থীদের দ্বারা পুনরায় স্থাপন করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি: অন্তর্ধান এবং পুনরাবির্ভাব
আমরা ভাইরাল ছবির রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ২০২৩ সালে বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যম প্রথম আলোর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভাইরাল ছবিটি দেখতে পাই। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিখোঁজ হওয়া ভাস্কর্যের মাথার যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে উদ্ধার করা হয়।
এরপর, আমরা সম্পর্কিত কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখি একাধিক বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম এই ঘটনা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীদের দ্বারা স্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ভাষ্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
ঢাবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, "আমরা জানার চেষ্টা করছি ভাষ্কর্যটা ওখানে বসিয়েছে কে? কেনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ব্যতীত একটা নান্দনিক ভাষ্কর্যের সঙ্গে আরেকটা ভাষ্কর্য বসিয়ে এর সৌন্দর্য নষ্ট করা হয়েছে।"
আমরা ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর একটি ভিডিও রিপোর্টে ভাইরাল ভিডিওর অনুরূপ দৃশ্য দেখতে পাই। প্রতিবেদনে আমরা ছাত্র ইউনিয়নের এক বিভাগীয় সভাপতি এবং ঢাবির ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র শিমূল কুম্ভকারের একটি বিবৃতি পাই। কুম্ভকার রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তি স্থাপন উদ্যোগের অগ্রভাগে ছিলেন।
প্রতিবেদনটিতে কুম্ভকার অভিযোগ করেন যে তারা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকালে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে জানতে পারেন এবং মূর্তিটির অবস্থান সম্পর্কে তাদের কাছে কোনও তথ্য ছিল না। তিনি আরও জানান, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে এই মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল।
আমরা আরও দেখি ভিডিও প্রতিবেদনটিতে ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য স্থাপনের দৃশ্য দেখা যায়, যার কথা কুম্ভকার উল্লেখ করেন।
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাস্কর্যটির অংশগুলি নিয়ে শিক্ষার্থীরা তা পুনর্নির্মাণ করে।
প্রতিবেদনের এক অংশ অনুযায়ী, "ঢাবির শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের চারপাশে ভাস্কর্যটির বেশ কয়েকটি অংশ খুঁজে পায় এবং রাজু মেমোরিয়াল ভাস্কর্যের পাশে সেটি পুনরায় তৈরি করতে সক্ষম হয়। তবে, এবার ভাস্কর্যটি ভিন্ন। ভাস্কর্যটি নিখোঁজ হওয়ার পরে, ক্ষুব্ধ ঢাবি শিক্ষার্থীরা "গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ" লেখা একটি ব্যানার টানায় যেখানে ভাস্কর্যটি প্রথমে স্থাপিত ছিল।"