বিজেপি দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সদস্যরা ও কিছু দক্ষিণপন্থী টুইটার হ্যান্ডেল ভুয়ো দাবিতে টুইট করে বলে কিছুদিন আগে সরস্বতী পুজোর আয়োজনে অনুমতি না দিলেও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (Presidency University) পড়ুয়াদের জন্য ইফতারের (Iftar Row) আয়োজন করেছে।
বুম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের লাগোয়া হস্টেল ভবনের এলাকাটি ঘুরে দেখে নিশ্চিত হয় ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয় ইডেন হিন্দু হস্টেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নয়।
বুম দেখে ভাইরাল দাবিটি একাধিক কারণে ভুয়ো। প্রথমত, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় তার চত্বরে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেয় না। দ্বিতীয়ত, ইফতার অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল ইডেন হিন্দু হস্টেলে, যেখানে প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা থাকে। তৃতীয়ত, এই হস্টেলেই এবছরেও সরস্বতী পুজো এবং শিবরাত্রির মতো হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেত্রী কেয়া ঘোষ ফেসবুকে ইরফান সাদিকের পোস্ট করা ইফতারের ছবির এক পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে দাবি করেন, “প্রেসিডেন্সি কলেজের হিন্দু হস্টেলে দাওয়াত-এ-ইফতার! দয়া করে মনে রাখুন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় তার ‘ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের পরিপন্থী’ বলে এবছর সরস্বতী পুজো আয়োজনের অনুমতি দেয়নি”।
টুইটটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
আরএসএসের মুখপত্র অর্গানাইজারও ফেসবুক পোস্টটি ব্যবহার করে এক প্রতিবেদনে ভুয়ো দাবিতে লেখে, “পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য প্রশাসনের মদতে গত ৫ এপ্রিল দাওয়াত-এ-ইফতারের আয়োজন করে। জানুয়ারি মাসে এই একই প্রশাসনিক অফিসাররা সরস্বতী পুজোর আয়োজনে অনুমতি দেয়নি। প্রেসিডেন্সি কলকাতায় অবস্থিত রাজ্য সরকার পরিচালিত এক বিশ্ববিদ্যালয়।”
তথ্য যাচাই
বুম লক্ষ্য করে ফেসবুকে এই পোস্ট করা ব্যক্তি ইরফান সাদিক হলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতকোত্তর ছাত্র। ৫ এপ্রিল, ২০২৩, সাদিক তার ফেসবুক প্রোফাইলে এই ইফতারের সচিত্র বিবরণী আপলোড করেন। আমাদের তিনি জানান, প্রেসিডেন্সি সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও হস্টেল চত্বরে আয়োজিত ওই ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছিল।
পোস্টটির আর্কাইভ দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সাদিক বুমকে বলেন, “হিন্দু হস্টেলের আবাসিকরাই এই ইফতারের আয়োজন করেন। ওই হস্টেলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা বসবাস করেন। এ বছরেই হস্টেল চত্বরে সরস্বতী পুজোর আয়োজনও করা হয়েছিল।”
সাদিক আরও বিশদে ব্যাখ্যা করে জানান, “অনুষ্ঠানটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আয়োজিত হয়নি”।
বুমের তরফেও ইডেন হিন্দু হস্টেল চত্বর পরিদর্শন করা হয় এবং আমরা হস্টেলের আবাসিকদের সঙ্গেও কথা বলি। আমরা এটাও লক্ষ্য করি যে, ইডেন হস্টেল ভবনটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের একেবারে লাগোয়া। ইডেন হিন্দু হস্টেল ভবনটির বাইরের দৃশ্য নীচে দেখা যাবে।
যে মাঠটিতে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল, আমরা সেখানেও যাই এবং ভাইরাল হওয়া ছবির সাথে সেই হস্টেল মাঠের মিল খুঁজে পাই।
পল্টন শীল শর্মা, ইফতার আয়োজনকারী এক হস্টেল-আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, আমাদের জানান, “হস্টেলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আবাসিক পড়ুয়ারা সকলে মিলেই ইফতারের আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এর আদৌ কোনও সম্পর্কই নেই। আবাসিকরা নিজেরাই চাঁদা তুলে এর আয়োজন করেছে। আমাদের হস্টেলের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও সম্পর্ক থাকে না।”
শীলশর্মা আরও জানান, হস্টেলের ভিতর সরস্বতী পুজো এবং শিবরাত্রিরও আয়োজন করা হয়।
হিন্দু হস্টেলের আরও এক আবাসিক শেখ সইদুল আমাদের বলেন, “এই একই মাঠে আমরা কয়েকদিন আগে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানও আয়োজন করেছিলাম। ইফতার গত দুবছর ধরে করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এলাকায় কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেন না, তাই আবাসিকরা হস্টেল চত্বরেই এ সবের আয়োজন করে থাকে।”
এবছরের ২৬ জানুয়ারি হস্টেল চত্বরে আয়োজিত সরস্বতী পুজোর ছবি নীচে দেওয়া হল।
ইডেন হিন্দু হস্টেল এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা প্রাঙ্গণের ছবি নীচের তুলনায় স্পষ্ট হবে।
এছাড়াও আমরা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাদ মাহমুদের সঙ্গেও কথা বলি, যিনি আমাদের স্পষ্টভাবে জানান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেওয়া হয় না।
বুমকে মাহমুদ বলেন, “পড়ুয়ারা বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হস্টেল প্রাঙ্গণে আয়োজন করে থাকে। কিছু রাজনৈতিক দল এই বছর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সরস্বতী পুজো আয়োজনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কঠোর ভাবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাঁদের যুক্তি, এত বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের পুজোর অনুমতি দেওয়া হয়নি, এখনও দেওয়া হবে না। হিন্দু হস্টেলের ভিতর আবাসিকরা এই সব অনুষ্ঠান পারস্পরিক সম্প্রীতির পরিবেশে আয়োজন করে থাকে, সেখানে কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ বিশেষ থাকে না।”
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর আয়োজন ঘিরে বিতর্ক
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যরা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টসকে চিঠি লিখে এই বছর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সরস্বতী পুজো আয়োজনের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি এক ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান - এই যুক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষ সেই অনুমতির প্রস্তাব খারিজ করে দেন।
এরপর, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথের ঠিক বাইরে এই পুজোর আয়োজন করে বলে জানায় এবিপি আনন্দ।