সোশাল মিডিয়ায় একটি বার্তা ভাইরাল হয়েছে, যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, যদি তাদের অ্যাডমিনরা তাদের প্রেরিত বার্তায় নরেন্দ্র মোদী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল কিংবা রাহুল গান্ধীর ছবি ফরোয়ার্ড করে, তবে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে। বার্তাটিতে আরও বলা হয়েছে যে, পুলিশ এ ব্যাপারে নজর রাখছে এবং পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনরা যেন এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন এবং যারা এ কাজ করবে, তাদের গোষ্ঠী থেকে বের করে দেন।
বুম তার হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬১১১) বার্তাটির সত্যতা যাচাই করার অনুরোধ পেয়েছে।
ফেসবুকেও ভাইরাল
আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি, ফেসবুকেও বার্তাটি ভাইরাল হয়েছে।
তথ্য যাচাই
এ ধরনের বার্তা যে এই প্রথম ভাইরাল হলো, এমন নয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসেও এই ধরনের একটি ভুয়ো বার্তার পর্দাফাঁস করেছিল বুম এবং প্রমাণ করেছিল বেশ কয়েকটি দিক থেকে বার্তাটি ভুয়ো। ২০১৮ সালের ভুয়ো বার্তাটির সঙ্গে এবারের বার্তার হুবহু মিল রয়েছে কেবল একটি বাক্যে ছাড়া, সেটি হলো: পুনে, চেন্নাই, মুম্বই ও দিল্লিতে ২৬০ জন হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনকে জেলে পাঠানো হয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মিতানএক্সপ্রেস ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটে এই বাক্যটি প্রথম দেখা যায়। কিন্তু এই শিরোনামটি কোনও উৎস জানায়নি। আমরা এমন কোনও সংবাদ-রিপোর্টের সন্ধান পাইনি, যেখানে ওই সব শহরে ২৬০ জন হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনকে গ্রেফতার করার কোনও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
পুলিশ হোয়াটসঅ্যাপের ওপর নজর রাখছে এবং সাইবার অপরাধ শাখা সব হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর ফোল্ডারে লক্ষ্য রাখছে
বাস্তবে এটা সম্ভব নয়, কেননা এই সোশাল মিডিয়া মঞ্চগুলিতে চালাচালি করা বার্তাগুলি আদ্যপান্ত এনক্রিপ্ট করা থাকে, যা ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রামের ক্ষেত্রে থাকে না। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে আমরা মহারষ্ট্রের রাজ্য সাইবার অপরাধ শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, যারা আমাদের জানায় যে বার্তাটি ভুয়ো এবং তাদের পক্ষে হোয়াটসঅ্যাপে চালাচালি হওয়া বার্তার উপর নজরদারি চালানো সম্ভব নয়, যেহেতু সেগুলি এনক্রিপ্ট করা থাকে।
সাম্প্রদায়িক পোস্ট খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান কমিটি তৈরি এবং সেই পোস্ট-প্রেরকদের খুঁজে বের করে দেওয়ানি কার্যবিধির ৪৪-৫৮ ধারায় শাস্তি দেওয়া হবে
ভাইরাল হওয়া বার্তার এই দাবিটাও ভ্রান্ত, কেননা দেওয়ানি কার্যবিধির উল্লিখিত ধারাগুলিতে সোশাল মিডিয়ার কাজকর্মের কোনও সম্পর্কই নেই। ২০১৮ সালেই বুম এ ব্যাপারে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী অপর গুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিল, যিনি জানিয়েছিলেন, ওই ধারাগুলি সোশাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়।
হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনদের দায়ী করা সম্পর্কে আইনি মত
বুম সে সময় অপর গুপ্তকে প্রশ্ন করেছিল, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর অ্যাডমিনদের দায়ী করা যায় কিনা। জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন— "হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনদের দায়ী করা উচিত নয়, কারণ এই গোষ্ঠীগুলো পাশ করে যাওয়া কলেজ ছাত্র, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে তৈরি হয়, কোনও অপরাধমূলক মতলব নিয়ে নয়। অ্যাডমিনদের পক্ষে আগাম জানাও সম্ভব নয় গোষ্ঠীর সদস্যরা ভবিষ্যতে কী পোস্ট করতে পারে।"
অতীতে কি পুলিশ কখনও হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাডমিনদের গ্রেফতার করেছে?
হ্যাঁ, অতীতে হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর অ্যাডমিনদের গোষ্ঠীর সদস্যদের পোস্টের জন্য দোষী ঠাওরানো হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই টাইমস অফ ইন্ডিয়া রিপোর্ট করেছিল, অন্য একজনের ফরোয়ার্ড করা একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার জন্য মধ্যপ্রদেশের রায়গড় জেলার জুনায়েদ খানকে ৫ মাস জেলে ভরে রাখা হয়েছিল।
তিনি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যার অ্যাডমিন ইরফান একটি আপত্তিকর পোস্ট করেছিল। স্থানীয় কয়েকজন তালিন থানায় ইরফান এবং অ্যাডমিন-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।
পুলিশ সে সময় দাবি করে যে, জুনায়েদই হচ্ছে ওই হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর অ্যাডমিন্সট্রেটর, কিন্তু তার পরিবারের লোকেরা এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। জুনায়েদের ভাই ফারুক খান টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে জানান, "জুনায়েদ ওই গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন বটে, কিন্তু তার অ্যাডমিন নন। যখন বিষয়টি নজরে আসে, সে সময় তিনি পারিবারিক কাজে রাতলমে ছিলেন। অ্যাডমিন তখন ওই গোষ্ঠী ছেড়ে দেন এবং অন্য একজন গোষ্ঠীর অ্যাডমিন হন, তারপর তিনিও ছেড়ে দিলে জুনায়েদ নিজের ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই গোষ্ঠীর অ্যাডমিন হয়ে যান। কিন্তু আপত্তিকর পোস্টটি যখন শেয়ার হয়, তখন জুনায়েদ ওই গোষ্ঠীর অ্যাডমিন ছিলেন না।"
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ প্রেস ট্রাস্ট ইন্ডিয়ার রিপোর্টে জানা গেছে, অন্য একটি মামলায় ঝাড়খণ্ডের ছাতরা জেলায় উস্কানিমূলক বার্তা ও ভিডিও পোস্ট করার দায়ে একটি হোয়াট্স্যাপ গোষ্ঠীর অ্যাডমিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী রঞ্জিতকুমার রাম নামে ওই ব্যক্তি প্ররোচনামূলক ভিডিও ও বার্তা পোস্ট করার দায়ে ১৫ দিনের জন্য বিচারবিভাগীয় হেফাজতে ছিলেন।
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে গোষ্ঠীর অ্যাডমিনরা কী করতে পারেন?
অ্যাডমিনরা কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর অন্য সদস্যরাও ঘৃণা ও বিদ্বেষ উদ্রেককারী পোস্ট বিষয়ে নিকটবর্তী থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৯ ধারায় এটা করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তাই আইন অনুযায়ী পুলিশের কোনও এক্তিয়ার নেই গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা ভিডিও পোস্ট করলে তাকে গ্রেফতার করার, অন্তত আইনজীবীদের অভিমত সেটাই।