চার মিনিট লম্বা একটি ভিডিওতে এক চিকিৎসক মিথ্যে দাবি করেছেন যে, কোভিড-১৯'এর টিকা মানুষের শরীরের ডিএনএ বদলে দিতে পারে এবং আমাদের সমস্ত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ক্রিস্টিয়ান নর্থরাপ একজন স্থূলতা এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁকে 'দ্য ওপ্রাহ শো'য়েও একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেখা গেছে। বিল এবং মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ তুলেছেন যে তারা নিজেদের মুনাফার জন্য মানুষের বায়োমেট্রিক তথ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
বুম দেখেছে যে চার মিনিট লম্বা ক্লিপটি আসলে পলি টমি এবং নর্থরাপের একটি ৩৭ মিনিট লম্বা ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারের অংশ। পলি টমি একজন অটিজম অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি টিকাবিরোধী গোষ্ঠীর একজন সদস্য। এই গোষ্ঠী ২০১৬ সালে ভ্যাক্সড নামে সিনেমাটি বাজারে এনেছিল। ওই সাক্ষাৎকারে নর্থরাপ পাঁচটি দাবি করেছেন-
১। আরএনএ টিকা মানুষের শরীরের ডিএনএ বদলে দিতে পারে
২। মানুষের শরীরের নয় এমন ডিএনএ মানুষের মধ্যে অমানবিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারে
৩। টিকায় ব্যবহৃত ধাতব পদার্থ শরীরে এক ধরনের অ্যান্টেনা তৈরি করবে যা ফাইভ-জি টেকনোলজি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে
৪। এই টিকায় ন্যানো পার্টিকেল আছে যা বায়োমেট্রিক নির্ধারক হিসাবে কাজ করবে এবং যা নিয়ন্ত্রণ করবে বিল এবং মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন। এই বায়োমেট্রিক নির্ধারকগুলি নগদহীন আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হবে।
৫। যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রকে তাদের উপর নজরদারি করতে সাহায্য করবে ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির তৈরি লুসিফারেস।
তবে ড নর্থরাপ তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। পুরো বিষয়টি বুঝতে এবং এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে বুম একজন বায়োটেকনোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে।
বুম চার মিনিটের এই ভিডিওটি তার হোয়্যাটসঅ্যাপ হেল্পলাইনে পায়।
ভিডিওটির সঙ্গে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে, "ইন্টারনেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতামূলক ভিডিও। সত্যিটা হল এই টিকা আপনার ডিএনএ বদলে দিতে পারে। এই অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক আমাদের জানিয়েছেন কোভিড টিকায় কী আছে এবং এর উদ্দেশ্য কী? অবশ্যই দেখবেন। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক এবং লেখক ড ক্রিস্টিয়ান নর্থরাপ কোভিড-১৯ টিকা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যদি কোভিড-১৯ আক্রান্তের সেরে ওঠার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯% হয়, তা হলে এরা কেন সারা বিশ্বজুড়ে টিকা দেওয়ার চেষ্টা করছে?"
বুম আটত্রিশ মিনিট লম্বা আসল ভিডিওটি অ্যাক্টিভিস্ট টুল নামে একটি ফেসবুক পেজে দেখতে পায়, যা বর্তমানে ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
তথ্য যাচাই
বুম নর্থরাপের দাবিগুলিকে বুঝতে ইন্ডিয়ান সায়েন্সটিস্ট রেসপন্স টু কোভিড-১৯'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োইনফরমেটিক্সের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড এস কৃষ্ণস্বামীর সঙ্গে কথা বলে।
আমরা আরও জানতে পারি যে নর্থরাপ একজন টিকাবিরোধীচিকিৎসক এবং কোভিড-১৯ যে একটি ষড়যন্ত্র, সেই বিষয়ক "প্ল্যানডেমিক" নামের সিনেমাটি শেয়ারও করেন। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তথ্যবিকৃতি করছেন।
১। আরএনএ টিকা মানুষের ডিএনএ বদলে দেবে
মিথ্যে তথ্য
যদিও এমআরএনএ টিকা মানুষের কখনও ব্যবহার করা হয়নি, এই ধরনের অনেকগুলি টিকা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। ফাইজারটিকা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এমআরএনএ টিকা কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কাজ দিতে পারে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না তার টিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই প্রযুক্তি অনুসরণ করেছে। নর্থরাপ দাবি করেছেন এই আরএনএ টিকা ডিএনএ দিয়ে তৈরি মানুষের জেনোম বদলে দিতে পারে।
কৃষ্ণস্বামী এই দাবিটিকে মিথ্যে বলেছেন কারণ তাঁর মতে, এই দাবিটি জেনেটিক মেটেরিয়ালের মূল বিষয়ের বিরোধী। "আরএনএ সাইটোপ্লাজমে দেখা যায়। আর ডিএনএ থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। ডিএনএ বদলাতে হলে আরএনএ-কে নিউক্লিয়াসের কাছে পৌঁছাতে হবে এবং এই টিকা মোটেই সেই ভাবে কাজ করে না।"
ভাইরাসের ক্ষেত্রে আরএনএ হল জেনেটিক কোড যার কিছু অংশ বৈজ্ঞানিকরা সরিয়ে দেন এবং লিপিড দিয়ে মুড়ে দেন যাতে তা মানব শরীরে সহজে ঢুকতে পারে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর যে কোষে আরএনএ পৌঁছেছে, সেখানে প্রতিষেধক টিকা পৌঁছোয় এবং করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে চেষ্টা করে। তার ফলে মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়। এই প্রতিরোধক্ষমতা আরএনএ'র বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং আক্রান্ত কোষগুলিকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য মেমারি টি সেল তৈরি করে। কোনও মানুষ সার্স-কভিড-২'র সংস্পর্শে এলে এই অ্যান্টিবডি এবং টি সেল কাজ করতে শুরু করে।
২। মানব শরীরের অংশ নয় এমন ডিএনএ মানব শরীরে অবাঞ্ছিত আচরণ করতে পারে
এই তথ্য বিভ্রান্তিকর
নর্থরাপ এর পর দাবি করেছেন যে এই টিকাগুলি অন্য সেল লাইনের জেনেটিক মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি সুতরাং মানব শরীরের অংশ নয় এমন ডিএনএ মানুষের মধ্যে হিউম্যান কাইমের তৈরি করতে পারে এবং তার ফলে আমাদের মধ্যে অন্য প্রাণীর বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে পারে।
প্রথমতঃ মূল শব্দটি হল কাইমেরা। ড কৃষ্ণস্বামী বলেছেন যে পুরাণে এই প্রাণীরা যথেষ্ট পরিচিত। "কাইমেরা তখনই বলা হয় যখন দুটি আলাদা ডিএনএ'র সেট মানুষের শরীরে দেখা যায়। তার অর্থ এই নয় যে আমাদের মধ্যে অন্য প্রাণীর বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে।"
কৃষ্ণস্বামী আরও বলেন যে, মানুষের শরীরের ডিএনএ আসলে এক ধরনের কাইমেরা কারণ বিবর্তনের ফলে মানুষের শরীর বিভিন্ন জেনোমিক সারনি দিয়ে তৈরি যার অন্য অনেক প্রানীর সঙ্গে মিল আছে। "আমাদের প্ল্যাসেন্টায় এক ধরনের জেনোমিক সারণি আছে যা ভ্রূণকে পুষ্টি দেয় এবং শরীরে ধরে রাখে যাতে তা বাইরে বেরিয়ে না যায়।"
১৯৯৭ ওবং ২০০১ সালের বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে যে শরীরের জেনোমে বিভিন্ন রেট্রোভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে যা শরীরে ভ্রুণ ধরে রাখা এবং তার বৃদ্ধির মত শরীরের বিভিন্ন কার্যকলাপকে সাহায্য করে।
৩। টিকায় যে ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে তা শরীরে অ্যান্টেনা তৈরি করবে এবং যা ফাইভ-জি টেকনোলজি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
মিথ্যে তথ্য
মার্চে কোভিড-১৯ অতিমারি ঘোষণা করার পর থেকেই ফাইভ-জি কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে বোলে দাবি করা হয়। বুম এর আগে এ রকম অনেকগুলি দাবি মিথ্যে প্রমাণ করেছে এবং জানিয়েছে যে এই দাবির পিছনে কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
নর্থরাপ অবশ্য এই গল্পে একটি অন্য মোড় এনে দিয়েছেন এবং তিনি দাবি করেছেন যে এই টিকায় যে ধাতু এবং বিষাক্ত জিনিস রয়েছে, তা শরীরে এক ধরনের অ্যান্টেনা তৈরি করবে যা ফাইভ-জি রেডিয়েশন এবং টেকনোলজি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফাইভ জি রেডিয়েশন ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বহু টিকা বিরোধী ষড়যন্ত্রের ধারণা উঠে এসেছে এবং তাতে বলা হয়েছে রেডিও তরঙ্গ অন্য রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
বৈজ্ঞানিকরা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বার বার এই সব দাবি মিথ্যে বলে জানিয়েছেন। ফাইভ-জি একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি এবং এখনও পর্যন্ত মানুষের শরীরে কোনও রোগ ছড়াচ্ছে বলে জানা যায়নি।
৪। এই টিকায় ন্যানো পার্টিকেল আছে যা বায়োমেট্রিক নির্ধারক হিসাবে কাজ করবে এবং যা নিয়ন্ত্রণ করবে বিল এবং মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন। এই বায়োমেট্রিক নির্ধারকগুলি নগদহীন আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হবে।
মিথ্যে তথ্য
নর্থরাপ মাইক্রোসফটের ০৬০৬০৬ পেটেন্টের ব্যাপারে বলেছেন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এবং তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। তাঁরা বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন চালান। নর্থরাপ দাবি করেছেন যে, এই পেটেন্ট করোনাভাইরাসের টিকার জন্য এবং এ ক্ষেত্রে বিল গেটস ন্যানোপার্টিকেলের মধ্যে মাইক্রচিপ ঢুকিয়ে দেবে যার মাধ্যমে বায়োমেট্রিক তথ্য পাওয়া যাবে এবং সেগুলিকে ক্রিপটোকারেন্সির বদলে বিক্রি করা হবে।
বুম দেখেছে যে নর্থরাপের দাবি করা সংখ্যার একটি পেটেন্ট গেটসের সত্যিই আছে তবে তার সঙ্গে মাইক্রচিপ, ন্যানোপার্টিকেল বা কোভিড-১৯ টিকার কোনো সম্পর্ক নেই। যে পেটেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছে তাতে বিশেষ কিছু ব্যায়াম করার জন্য লোককে ক্রিপটকারেন্সি পয়েন্টে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারকারীদের কাছে যে যন্ত্র আছে তার সঙ্গে সেন্সর লাগানো আছে। ওই সেন্সরের মাধ্যমে বোঝা যাবে ঠিক নির্দেসিকা মেনে কাজ করা হচ্ছে কিনা এবং তার পর ক্রিপটোকারেন্সি দেওয়া হবে কিনা তা ঠিক করা হবে।
৫। ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির তৈরি লুসিফারেস যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের উপর নজর রাখতে সাহায্য করবে।
এই তথ্য আংশিক ভাবে সত্য
ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি ২০১৯ সালে আদের লুসিফারেস প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করে। এই প্রযুক্তিতে ত্বকের উপর ডাই করা কালি দেওয়া হবে যা দেখে বোঝা যাবে ওই ব্যক্ত টিকা নিয়েছে কি না। টিকা নেওয়ার সময় মাইক্রো-নিডল দিয়ে দেওয়া এই ডাই কালি ইনফ্রারেড স্ক্যানারের মাধ্যমে টিকা দেওয়া হয়েছে কি না সেই বিষয়ক তথ্য রাখতে সাহায্য করবে।
হামের টিকার জন্য তৈরি এই প্রযুক্তি কোভিড-১৯ টিকার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে কি না সেই বিষয়ে অনুমোদন এখনও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: 'ত্রাতা সহোদর' ও জিন ঘটিত রোগনির্ণয় কিছু নৈতিক প্রশ্ন