বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু ঘিরে নানা রকম ষড়যন্ত্রের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে তাঁর সহ-অভিনেতা, বলিউডের প্রযোজক, কিছু প্রভাবশালী পরিবার এবং রাজনৈতিক নেতাদের দিকে। এখন আবার একটা নতুন ধারণা উঠে এসেছে, যাতে অভিযোগ করা হয়েছে যে প্রয়াত অভিনেতা একটি ভিডিও গেম প্রজেক্টে কাজ করছিলেন এবং তাঁকে সে কারণেই খুন করা হয়েছে।
এই ধারণা অনুসারে ফৌ-জি নামের নতুন মোবাইল গেম আসলে রাজপুতের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তাঁকে খুন করে ওই আইডিয়া চুরি করে নেওয়া হয়েছে। নেটিজেনরা এও দাবি করেছেন যে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অক্ষয় কুমার জড়িত। তিনি গত সপ্তাহে টুইটারে এই গেমটির ব্যাপারে প্রথম ঘোষণা করেন।
এনকোর নামের ব্যাঙ্গালোরের একটি সংস্থা এই গেমটি তৈরির পিছনে রয়েছে। বিশাল গোন্দল এই সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং লগ্নিকারী। তিনি এই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন এবং বুমকে জানিয়েছেন যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই গেমের কাজ চলছে, এবং এর সঙ্গে সুশান্ত সিং রাজপুতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। ইন্টারনেটে যারা এই সব অভিযেগ ছড়াচ্ছে, গোন্দল ও এনকোর গেমস তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগও দায়ের করেছেন।
১৪ জুন রাজপুতকে তাঁর বান্দ্রার বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা বলে জানানো হয়।
২ সেপ্টেম্বের কেন্দ্রীয় সরকার টেন্সেন্ট গেমসের তৈরি পাবজি মোবাইল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। দুদিন বাদেই অক্ষয় কুমার একটি নতুন অ্যাকশন গেম লঞ্চ করেন, যার নাম ফিয়ারলেস অ্যান্ড ইউনাইটেড গার্ডস বা ফৌ-জি।
কুমারের টুইটের উত্তরে গাল্ফ-অঞ্চলের সাংবাদিক মিনা দাস নারায়ণ অভিযোগ করেছেন যে রাজপুত একটি গেমের উপর কাজ করছিলেন, যার আইডিয়া চুরি হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা হয়তো কেউ কুমারকে দিয়েছে।
দাস আরও
অভিযোগ করেছেন যে ফৌ-জির ডেভেলপার কলিসন অব ইনোসেন্স নামে হার্ড রক ব্যান্ডের একটি অ্যালবামের কভার থেকে এই গেমের পোস্টারের ছবির আইডিয়া চুরি করেছে।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিভোর আনন্দ নামে এক ব্যক্তি একটি টুইটে দাবি করেন যে ফৌ-জি আসলে একটি এআই গেম প্রজেক্ট, যার উপর রাজপুত কাজ করছিলেন। যদিও তিনি জানাননি যে তিনি কী ভাবে এই তথ্য পেয়েছেন বা তাঁর এই দাবির পক্ষে তিনি কোনও প্রমাণও দেননি।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আনন্দ ফের টুইট করে দাবি করেন, তাঁর কাছে প্রমাণ আছে যে রাজপুত এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ভিত্তিক গেমটির পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। আনন্দ লেখেন, "আগে আমরা এটা খুঁজে পাইনি, কারণ এটা তাঁর নিজের নামে ছিল না।" টুইটে একটি ভিডিও অ্যাটাচ করে আনন্দ দাবি করেন, অভিনেতা সোনু সুদ এবং ফিল্ম প্রযোজক মনীশ মু্ন্দ্রাও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আবারও তাঁর দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ পেশ করেননি আনন্দ।
৭ সেপ্টেম্বর আনন্দ এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আগুনে ঘি ঢালেন এবং জানান যে কুইকি ডিজিটাল মিডিয়া নামের একটি ডিজিটাল মিউজিক প্ল্যাটফর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখ্য আধিকারিক সমীর বাঙ্গরা, যিনি
১৪ জুন একটি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান, তিনিও রাজপুতের সঙ্গে তাঁর এআই গেমিং প্রোজেক্টে কাজ করছিলেন এবং সে কারণেই তাঁকে খুন করা হয়েছে।
এই সংযোগ ধরে আনন্দ শেষ পর্যন্ত জানিয়েছেন যে গোন্দল এই খুনের সঙ্গে জড়িত এবং তিনিই "এতগুলি খুনের রহস্যের আসল চাবিকাঠি।"
আনন্দ দাবি করেছেন যে তিনি বাঙ্গারার মৃত্যুর সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের তদন্তের জন্য আবেদন করবেন। এ রকম কোনও আবেদন জমা পড়েছে কি না, তা বুম নিজে যাচাই করে দেখেনি।
আমরা আনন্দের বক্তব্যের সত্যতার উপর মন্তব্য করার জন্য আনন্দকে অনেক বার ফোন করি, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
"ফেব্রুয়ারি থেকে ফৌ-জির কাজ চলছে"
বুম গোন্দলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং জানান যে রাজপুত এই গেম ডেভেলপমেন্ট বা ডিজাইনের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত ছিলেন না। আর ব্যাঙ্গালোরের একটি টিম এই কাজ করেছে।
গোন্দল বলেন, "২৫ জন প্রোগ্রামার, শিল্পী, টেস্টার এবং ডিজাইনারের একটি টিম যারা আগেও বিভিন্ন নামী গেমিং টাইটেলে কাজ করেছেন তাঁরাই এখন ফৌ-জির গেম তৈরির কাজ করছেন। একটি গেম ডেভেলপ করতে ৬ থেকে ৮ মাস সময় লাগতে পারে। গেমের জটিলতার উপর তা নির্ভর করে। আমরা বেসিক ইঞ্জিনের উপর কাজ শুরু করি ফেব্রুয়ারি থেকে এবং জুন থেকে আমরা গালওয়ান ভ্যালি লেভেলে, যেখানে মুখোমুখি লড়াই হয়, তার কাজ আরম্ভ করি"।
অক্ষয় কুমার এই প্রোজেক্টের সঙ্গে কী ভাবে জড়িত? গোন্দল জানান, "উনি এই গেমের একজন মেন্টর এবং গাইড। তাঁর এই গেমের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব কোনো স্বার্থ নেই।
গোন্দল আরও জানান যে রাজপুতের মৃত্যুর সঙ্গে তিনি জড়িত বলে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি এবং এনকোর গেমস পুলিশে একটি অভি্যোগ দায়ের করেছেন। বিভিন্ন টুইটার ব্যবহারকারীরা তাঁর বিরুদ্ধে যেসব টুইট করেছে, তার স্ক্রিনশট এই অভিযোগের সঙ্গে তিনি জমা করেছেন। অভিযোগের প্রতিলিপি দেখতে
এখানে ক্লিক করুন।
ফৌ-জি রাজপুতের আইডিয়া ছিল এই অভিযোগ অস্বীকার করে এনকোর গেমস টুইটারে তাদের একটি ব্যাখ্যা টুইট করেছে। তারা আরও জানিয়েছে যে এই গেমের যে পোস্টার একটি অ্যালবাম কভার থেকে অনুকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে দাবি করেছেন, সেটি শাটারস্টকের স্টক ফোটো থেকে কেনা হয়েছে।
সুশান্ত সিং রাজপুত কি একটি গেমের উপর কাজ করছিলেন?
রাজপুত ভিডিওগেমের উপর কাজ করার ব্যাপারে বুম প্রমাণ খুঁজতে শুরু করে, তিনি ফৌ-জির কনসেপ্ট তৈরি করেছেন, এই দাবিটি কি তথ্যপ্রমাণের ধোপে টিকতে পারে?
রাজপুতের ২০২০ সালের এপ্রিলের ইন্সটাগ্রাম পোস্ট দেখতে পাই যাতে তিনি জানিয়েছেন যে তিনি কম্পিউটার গেমিং খুব পছন্দ করেন এবং খান অ্যাকাডেমি থেকে কোডিং শিখতে শুরু করেছেন এবং তিনি "একেবারেই প্রাথমিক স্তরে আছেন"।
তাঁর মৃত্যুর পরই
পিঙ্কভিলা নামে একটি বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র থেকে তারা জানতে পেরেছে যে প্রয়াত অভিনেতা একটি গেম ডিজাইন করার পরিকল্পনা করছিলেন, এবং তিনি তা নিয়ে এক জন ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তবে রাজপুত কোনও গেমের জন্য পেটেন্ট করার চেষ্টা করেছিলেন কি না, তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
ফৌ-জির ডেভেলপমেন্ট শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে আর রাজপুত কোডিং শিখতে শুরু করেন এপ্রিলে। তাঁর মৃত্যুর আগে এত কম সময়ের মধ্যে তিনি নিজে এ রকম একটা গেম বানাবেন, তার সম্ভাবনা কম।
এ ছাড়া আমরা আরও দেখতে পাই, কর্ণধার হিসাবে
তিনটি আলাদা আলাদা সংস্থায় রাজপুতের নাম রেজিস্টার করা হয়েছে— ইন্সাই ভেঞ্চারস প্রাইভেট লিমিটেড, (২০১৮ সালের মে মাসে রেজিস্টার করা হয়), ভিভিড্রেজ রিয়ালিটিক্স প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রেজিস্টার করা হয়), এবং ফ্রন্ট ইন্ডিয়া ফর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন (২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে রেজিস্টার করা হয়)।
ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্য এবং সমাজসেবা ইন্ডাস্ট্রির অধীনএ একটি অ-লাভমূলক প্রতিষ্ঠান।
ইন্সাই ভেঞ্চারস প্রাইভেট লিমিটেড তাদের
লিঙ্কডইন পেজে নিজেদের সম্পর্কে লিখেছে যে এটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি নিয়ে কাজ করে। ইন্সাইতে রাজপুতের অংশীদার বরুণ মাথুর
জানিয়েছেন যে রাজপুত এই কোম্পানীর মাধ্যমে একটি ভার্চুয়াল চলচ্চিত্র বানাতে চেয়েছেন, যাতে ভারতের ১২ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে দেখানো হবে যাঁদের মধ্যে স্বামী বিবয়েকানন্দ, মাদার টেরেসা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধীর মত ব্যাক্তিত্বও রয়েছেন।
'কম্পিউটার সংক্রান্ত পরিষেবার' অধীনে ভিভিডরেজ রিয়ালিটিক্স রেজিস্টার করা হয়েছে। এখানে রাজপুতের প্রাক্তন বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী এবং তাঁর ভাই শৌভিক চক্রবর্তীকে কো-ডিরেক্টর হিসাবে রেজিস্টার করা হয়েছে।
রিয়া চক্রবর্তীর মতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করা এই সংস্থাটি রাজপুতের স্বপ্নের প্রোজেক্ট ছিল।
গোন্দল জানিয়েছেন যে ফৌ-জিতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন সংক্রান্ত শিক্ষার কোনও ব্যবহার নেই। এতে শুধু রয়েছে নন-প্লেয়েবেল চরিত্র এবং মেসিন বটস যেগুলি একটি নির্দিষ্ট কোড মেনে কাজ করার জন্যই প্রোগ্রাম করা। তার ফলে একটি নন-এআই গেমের আইডিয়া রাজপুতের এআই গেমিং প্রোজেক্ট থেকে নেওয়ার সম্ভাবনা কম।