একটি ভিডিওতে এক হিন্দু পুরোহিতকে দেশে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করার বিষয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু গত ১৬ এপ্রিল রাতে মহারাষ্ট্রের পালঘরে যে মর্মান্তিক ঘটনায় দুই পুরোহিত সহ তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটে, তিনি তাঁদের অন্যতম ছিলেন না। অথচ ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে যে, তিনিই সেই পুরোহিত যাঁকে অন্য পুরোহিতের সঙ্গেই পিটিয়ে মারা হয়। বুম দেখেছে, দাবিটি সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং এই দুজন আলাদা ব্যক্তি।
১৬ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের পালঘরে এক ৭০ বছর বয়স্ক ব্যক্তি সহ তিন জনকে উন্মত্ত জনতা চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে। তাঁরা একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওই গ্রামের ভিতর দিয়ে সুরাটের দিকে যাচ্ছিলেন। তাঁদের প্রথমে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়, তারপর লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, যতক্ষণ না তাঁদের প্রাণ বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের যে ভিডিও পাওয়া গেছে, তাতে বৃদ্ধ মানুষটিকে নৃশংসভাবে মারার দৃশ্য রয়েছে, যাঁর পাশে স্থানীয় পুলিশকেও দেখা যায়।
এই নৃশংস ঘটনার ভিডিও অনলাইনে আসতেই তা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায় এবং ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে অভিযোগ তোলা হয় যে, পুলিশ হামলাবাজদের হাত থেকে আক্রান্তদের রক্ষা করার কোনও চেষ্টাই করেনি। বুম এও দেখেছে যে, ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই ওই এলাকায় স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে এই ভুয়ো বার্তা ঘুরছিল যে, সেখানে ছেলেধরা ও চোরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: যেভাবে ছেলেধরার গুজব পালঘরে গণপিটুনির কারণ হয়ে উঠল
ভাইরাল হওয়া ৪ মিনিটের এই ভিডিওটিতে গেরুয়া বেশের এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে দেশে হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করার বিষয়ে আলোচনা করতে। তিনি সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন। ভিডিওটির দ্বিতীয় অংশে ওই গেরুয়াধারীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি ওঁকে দেখিয়ে বলছেন —'শ্রদ্ধেয় জিয়ার স্বামী।'
ভাইরাল ভিডিওয় হিন্দিতে একটি বার্তায় বলা হয়েছে, "ইনিই সেই ৭০ বছর বয়স্ক সাধু, যাঁকে পালঘরে নৃশংসভাবে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। ভিডিওটি দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন, কেন তাঁকে হত্যা করা হয় এবং আমাদের কাছে তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আত্মা যেন শান্তি পায়।"
ভাইরাল হওয়া পোস্টটি নীচে দেখুন। পোস্টটি আর্কাইভ করা আছে এখানে।
(হিন্দিতে মূল ক্যাপশন: ये वही 70 वर्षीय साधु है जिनकी पालघर में निर्मम हत्या कर दी गई है। वीडियो देखने के बाद समझ आ जाएगा कि इन्हें क्यो मारा गया और ये हमारे लिए कितने जरूरी थे....ईश्वर इनकी आत्मा को शांति दे।)
ভিডিওটি টুইটারেও শেয়ার করা হয়েছে।
ये वही 70 वर्षीय साधु है जिनकी पालघर में निर्मम हत्या कर दी गई है वीडियो देखने के बाद समझ आ जाएगा कि इन्हें क्यो मारा गया और ये हमारे लिए कितने जरूरी थे
— Bharat Magar (@BhartMagar) April 22, 2020
ईश्वर इनकी आत्मा को शांति दे pic.twitter.com/ROF8zRhr5B
আরও পড়ুন:
তথ্য যাচাই
বুম ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির একটি স্ক্রিনগ্র্যাব থেকে "জিয়ার স্বামী" শব্দগুলি বসিয়ে খোঁজ লাগিয়ে ইউ-টিউবে ২০১৪ সালে আপলোড হওয়া একটি ভিডিওর দেখা পায়, যাতে উপদেশদানরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে এবং "শ্রী ব্রতধারা রামানুজ জিয়ার স্বামী" বলে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ঢুঁড়ে আমরা সিয়াসত ডেইলি পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনও খুঁজে পাই, যেখানে তাঁকে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার জাতীয় সভাপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে ওই সাধুর কোনও ছবি ছাপা হয়নি।
একই শব্দগুচ্ছ বসিয়ে ফেসবুকে খোঁজ করেও বুম ওই নামের কারও প্রোফাইল খুঁজে পায়নি। এর পর আমরা নামটা একটু অদলবদল করে নিয়ে খোঁজ করে দেখি, শ্রীনিবাস ব্রতধরা জিয়ার নামে একজনের প্রোফাইল সেখানে রয়েছে এবং তার যে ছবি দেওয়া রয়েছে, ভাইরাল ভিডিওর ছবিটির সঙ্গে সেটা মিলে যায়। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে অবশ্য ব্যক্তিটি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, শুধু জানা যায় তাঁর বাড়ি হায়দরাবাদে। ফেসবুকের অন্য একটি প্রোফাইল ব্রতধার রামানুজজিয়ার-এ বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে, যেগুলি ভাইরাল ভিডিওর ছবির সঙ্গে মেলে।
জিয়ার উপাধিধারী সাধুরা রামানুজাচার্যের অনুগামীদেরই একটি শাখা, যিনি বৈষ্ণব ঐতিহ্যের প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ধর্মশাস্ত্রী ও দার্শনিক বলে মান্য।
বুম এরপর ওই প্রোফাইল এবং ভিডিও ক্লিপটি তন্ন-তন্ন করে খোঁজে এবং ২০১৫ সালে আপলোড হওয়া অন্য একটি ভিডিওর সন্ধান পায়, যেখানে তিনি হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এরপর বুম ওই দুটি ভিডিওতে দেখা সাধুর চেহারা, শরীরী ভাষা এবং বক্তব্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনা করে অনেক সাদৃশ্যই খুঁজে পায়।
দুটি ভিডিওতেই দেখানো সাধুর কপালে আঁকা তিলকের মধ্যেও সাদৃশ্য রয়েছে—জিয়ার স্বামী বলে গণ্য সাধুরা সকলেই এই একই ধাঁচের তিলক কপালে এঁকে থাকেন।
কিন্তু পালঘরে যে ৭০ বছর বয়স্ক পুরোহিতটি নিহত হয়েছেন, তাঁর কপালে এ ধরনের কোনও তিলক ছিল না। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কল্পবৃক্ষ গিরি নামে এই পুরোহিতটি ছিলেন জুনা আখাড়ার সদস্য। ভারতীয় দর্শনে আখাড়াগুলি হল বিতর্ক ও ধর্মীয় আলোচনার কেন্দ্র।
বুম ভাইরাল ক্লিপ এবং শ্রীনিবাস ব্রতধার জিয়ার-এর ভিডিওর স্ক্রিনশট ব্যবহার করে পালঘরে নিহত পুরোহিতের ছবির সঙ্গে তুলনা করে।
তা ছাড়া, শ্রীনিবাস ব্রতধারা জিয়ার সম্পর্কে আরও বিশদে জানতে বুম হায়দরাবাদে চিন্না জিয়ার আশ্রমের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। সেখান থেকে প্রত্যুত্তর পেলে এই প্রতিবেদনটি সংস্করণ করা হবে।