তিনটি পরস্পর সম্পর্কহীন ভিডিও, যার একটিতে সশস্ত্র পুলিশদের দেখা যাচ্ছে, অন্যটিতে কিছু স্বাস্থ্যকর্মীকে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন আহতের শুশ্রূষা করতে, এই সব একসঙ্গে জুড়ে মিথ্যে দাবি করা হচ্ছে যে, উহানে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের মারণ-ছোঁয়া থেকে বাঁচতে চিনা পুলিশ এখন রোগীদের হত্যা করছে।
বুম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে যে এই ভিডিওগুলির পরস্পরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এবং অন্তত দুটি ভিডিওয় চিনে সংক্রামিত করোনাভাইরাসের কোনও সংযোগ নেই।
কোভিড-১৯ নামে বর্তমানে সরকারিভাবে পরিচিত করোনাভাইরাসে চিনে অন্তত ১,৫২৭ জন লোকের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে এবং ৬৭ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছে (বর্তমান জনহপকিন্স তথ্য দেখুন এখানে)। চিনের উহান প্রদেশেই এই ভাইরাসের উৎসস্থল বলে মনে করা হচ্ছে, যার পরিণামে গোটা প্রদেশেই ঢোকা-বেরনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতে কেরালা রাজ্যের তিন জনের দেহে এই সংক্রমণের লক্ষণ মিলেছিল এবং তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজনের উপর্যুপরি পরীক্ষায় কোনও সংক্রমণের লক্ষণ আর না মেলায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপটি হিন্দি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রচারিত হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্লিপেই দাবি করা হচ্ছে যে, চিনা পুলিশ ভাইরাস আক্রান্তদের গুলি করে মেরে ফেলছে। পুরো ক্লিপিংই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও টুইটারে ছড়িয়েছে এবং বুম-এর হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও (৭৭০০৯০৬১১১) এটির সত্যতা যাচাইয়ের অনুরোধ এসেছে।
প্রথম ক্রমপর্যায়
৫৫ সেকেন্ডের এই ক্লিপটিতে তিনজন পুলিশকে দেখা যাচ্ছে একটি পুলিশের গাড়ির কাছে, যাদের মধ্যে একজন তার বন্দুকে গুলি ভরছে। এরপর ক্যামেরা ঘুরছে পুলিশটিকে একটি আবাসিক এলাকার দিকে যেতে দেখাতে। ভিডিওটি যে তুলছে, তাকে স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা বিবরণ দিতে শোনা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ক্রমপর্যায়
দ্বিতীয় দৃশ্যটিতে দেখা যাচ্ছে, একটা খোলা উঠোনের মতো জায়গায় কিছু লোক মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের দেখাশোনা করছে। আশপাশের লোকেদের চেহারা ভীত-সন্ত্রস্ত। এই ভিডিওতে প্রথমটির মতো কোনও বিবরণী কেউ দিচ্ছে না, কিন্তু দূর থেকে বন্দুকের গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ক্যাপশনে যদিও লোকেদের মেরে ফেলার কথা বলা হয়েছে, তবে এই ক্লিপিংটিতে কোথাও কোনও রক্তের দাগ দেখা যায়নি, বরং একজন লোকের নড়াচড়া দেখে মনে হয়, সে জীবিত এবং চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে।
তৃতীয় ক্রমপর্যায়
তৃতীয় ভিডিওটিতে হলুদ জ্যাকেট পরা একজনকে ফুটপাতে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যার উপর কেউ একজন ঝুঁকে রয়েছে এবং অদূরে একটি অ্যাম্বুলেন্স ও আরও কিছু গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। এই ক্লিপিংয়েও গুলির আওয়াজের মতো কিছু শোনা যাচ্ছে।
Meanwhile over 25,000 killed they have started shooting down all the people with the virus in China... this is so sad 🥺🥺🥺 pic.twitter.com/IfVWMUuSw6
— Rangoli Chandel (@Rangoli_A) February 13, 2020
রঙ্গোলি চান্দেল তার টুইটে দাবি করেছেন অন্তত ২৫ হাজার ভাইরাস আক্রান্তকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
তথ্য যাচাই
বুম এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, এই তিনটি ভিডিওই আলাদা-আলাদা ঘটনার এবং অন্তত দুটির সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনও সম্পর্কই নেই। এগুলি স্রেফ সম্পাদনা করে জোড়া হয়েছে এবং বন্দুকের গুলির আওয়াজ তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে, এগুলি চিনে ভাইরাস-আক্রান্তদের মেরে ফেলার ছবি।
আমরা দেখেছি, সশস্ত্র পুলিশের প্রথম ভিডিওটি ইয়ু শহরের এবং সম্ভবত বেশ পুরনো। সেসময় এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী একটি পাগলা কুকুরকে মারতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশকে ডাকা হয়েছিল। ফুটপাতে পড়ে থাকা তরুণের ছবি দেওয়া তৃতীয় ভিডিওটি বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পরিণাম। আর গুলির আওয়াজ বলে যেগুলোকে চালানো হচ্ছে, সেগুলো আসলে বাজি পোড়ানোর শব্দ, যা পরে জোড়া হয়েছে।
প্রথম ভিডিও—বন্দুকধারী পুলিশ
তিনজন পুলিশকে একটা গাড়ির কাছে (যার বনেটে চিনা ভাষায় 'পুলিশ' কথাটি লেখা আছে) দেখা যাচ্ছে, যাদের একজন তার বন্দুকটা প্রস্তুত করছে। তারা এরপর একটা আবাসিক এলাকায় একটা গলির মধ্যে ঢুকছে যখন ভিডিওগ্রাফারকে স্থানীয় ভাষায় কিছু বর্ণনা করতে শোনা যাচ্ছে। সেই বিবরণের ভাষা জানে এমন একজনকে দিয়ে সেটা অনুবাদ করে দেখা গেছে, সে বলছে: "বন্দুক তো রেডি হয়ে গেছে। আমরা জানিনা এ সব কী জন্যে... সাব-মেশিনগান, পিস্তল..."
বুম ঝেজিয়াং প্রদেশের ইয়ু শহরের এক স্থানীয় পুলিশের মাধ্যমে উইচ্যাটের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট হাতে পায়, যাতে ভুয়ো গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই পুলিশের পোস্টে লেখা: ''যদি কেউ এই ভিডিওটি শেয়ার করেন, তবে দয়া করে খোলসা করে সব জানাবেন> দুপুরবেলা ইয়ুর বিশেষ পুলিশ পুর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পায় এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো একটি বিশাল কুকুরকে খতম করতে... এর সঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারীর কোনও সম্পর্ক নেই।"
পুলিশটি নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছে, কিন্তু বুম উই-চ্যাট থেকে তার পোস্টের একটি স্ক্রিনশট তুলেছে, যা নীচে দেওয়া হলো।
বুম চিনের আন্তর্জাতিক টেলিভিসন নেটওয়ার্ক থেকে একটি টুইটও পেয়েছে, যাতে করোনাভাইরাসের সঙ্গে এই দৃশ্যটির যোগাযোগের কথা ইয়ু পুলিশ অস্বীকার করে বলেছে, এটা বিভিন্ন দৃশ্যকে এক জায়গায় সাজিয়ে জোড়া দেওয়ার দুরভিসন্ধি, যেখানে সশস্ত্র পুলিশ অফিসাররা কেবল একটা পাগলা জলাতঙ্ক রোগগ্রস্ত কুকুরকে মারার তোড়জোড় করছিলেন।
Police in Yiwu, Zhejiang said online video alleging them "shooting people sick with #coronavirus that refuse to be evacuated" is fake
— CGTN (@CGTNOfficial) February 13, 2020
The police said the video was "maliciously" manipulated with separate scenes since the armed officers were only dealing with a rabid dog pic.twitter.com/10NLLX7B1I
দ্বিতীয় দৃশ্য—চিকিৎসকরা রোগীদের পরীক্ষা করছেন
এই দ্বিতীয় ক্লিপটি শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে, এটি উহানের ঘটনা, যেখানে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। ২৫ জানুয়ারি ইউটিউবে এটি আপলোড করে দাবি করা হয়, পিছনে যে শব্দ শোনা যাচ্ছে, তা বন্দুকের গুলির। কিন্তু ক্লিপটিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়, গুলির নয়, শব্দগুলি দূরে বাজি ফাটানোর আওয়াজ।
আমরা সার্চ করে জানতে পারি ২৫ জানুয়ারি সারা দেশে জমকালো ভাবে পালন করা হয় চিনা নববর্ষ। খবর অনুযায়ী এবছর নববর্ষের অনুষ্ঠানে ভাটা পড়লেও আমরা ইউটিউবে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে ওই দিন বাজি ফোটানোর ভিডিও পেয়েছি।
তবে এই ভিডিওটা ঠিক কোথায় তোলা, সেটা বুম খুঁজে বের করতে পারেনি।
তৃতীয় ভিডিও—ফুটপাতে পড়ে থাকা হলুদ জ্যাকেট পরা লোক
এই ভিডিও ক্লিপটিতে হলুদ জ্যাকেট পরা এক তরুণকে ফুটপাতে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যার মুখের উপর হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে রয়েছে আর এক ব্যক্তি। ক্যামেরা ঘুরে গিয়ে একটি দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সকেও দেখাচ্ছে। এটিতেও দূরে বন্দুকের গুলি চলার মতো আওয়াজ নেপথ্যে শোনা যাচ্ছে।
আমরা ভিডিওটির দৃশ্য ও ধ্বনি অংশদুটি আলাদাভাবে পরীক্ষা করি এবং দেখি, গুলির শব্দের মতো আওয়াজ আদতে এই ভিডিওর অন্তর্ভুক্ত ছিল না, পরে এটা জোড়া হয়েছে এই ভুয়ো দাবি জানাতে যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের গুলি করে মারা হচ্ছে।
৩০ জানুয়ারির একটি টুইটে এই ভিডিও দৃশ্য রয়েছে, যেখানে নেপথ্যে কোনও গুলির আওয়াজ নেই, যা দেখে প্রমাণ করা যায়, এই সব শব্দ বা ধ্বনি পরে সম্পাদনা করে জোড়া হয়েছে।
中国政府在控制疫情的过程中,发生了严重的人道危机。从武汉返乡的村民被邻居举报,不满而把邻居割喉。武汉单亲父亲被强制隔离,脑瘫儿子独自在家被活活饿死。湖北人在全国范围内被围追堵截。视频中的男子因为紧急情况需要通过封锁的路口被打死。这些都是政府制造的人道灾难 pic.twitter.com/YjggUVymxa
— 极简大叔 (@COOOTV) January 30, 2020
যে টুইটার ব্যবহারকারী ভিডিওটি আপলোড করেন, তিনি এটিকে উহান প্রদেশের দৃশ্য বলে চালিয়েছেন, যেখানে একটি অবরুদ্ধ অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে গুলি করে মারা হয়। কিন্তু অন্য এক টুইটার ব্যবহারকারী এর জবাবে লেখেন, এটি তাঁর নিজের শহরের ঘটনা, যেখানে দুটি অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর মোটারসাইকেলে চড়ে দ্রুত গতিতে যাওয়ার সময় একটি থামে ধাক্কা খায়, তাদের মধ্যে একজন পরে মারাও যায়।
我来解释,这个事在我们镇上发生的,未成年擅自骑摩托,速度过快碰到路沿无法控制撞到柱子上。
— wenhao.hong (@RyPllPIchQEmrP1) February 1, 2020
তিনি আরও জানান—এটি হুয়াংমেই প্রদেশের উজু শহরের সিইউয়ান স্কুলের উল্টো দিকে ঘটে।
地点:湖北省黄梅县五祖镇思源学校对面
— wenhao.hong (@RyPllPIchQEmrP1) February 1, 2020
事件:两个未成年的骑摩托车太快。撞上路沿石失控。骑摩托车的死了坐摩托车重伤的送医院。
完全是驾驶人自己的过失。
造谣人称暴力执法将驾驶员打死,望各位理智。 pic.twitter.com/wGcppBTVEz
আমরাও ভিডিওটি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পাই, তরুণটি ফুটপাতের যেখানে পড়ে রয়েছে, তার কাছটা ভেঙে গেছে, যেন প্রচণ্ড গতিতে কিছু সেখানে আঘাত করেছে।
নীচে তারই স্ক্রিনশট দেওয়া হলো।
ফ্রান্সের একটি গণমাধ্যম ফ্রান্স ২৪অবজার্ভার ভিডিওটি উজু-র এক স্থানীয় লোকের সাক্ষ্যে যাচাই করে দেখেছে, ঘটনাটি ২৯ জানুয়ারির পথ-দুর্ঘটনারই পরিণাম এবং ফুটপাতে যে লোকটি পড়ে রয়েছে, সে ওই দুর্ঘটাতেই মারা যায়।
লোকটি জানায়: "আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এটি ২৯ জানুয়ারি সিউয়ান স্কুলের সামনের ঘটনা। আমি পাশেই থাকি এবং আমার কয়েকজন বন্ধুও যাওয়ার সময় দুর্ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখেছে। কিন্তু কিছু টুইটে যেমন দাবি করা হচ্ছে, ফুটপাতে পড়ে থাকা ব্যক্তিটি তেমন কোনও মহিলা নয়, ও একজন তরতাজা যুবক এবং পুলিশ তাকে গুলি করে মারেনি, সে মারা যায় পথ-দুর্ঘটনায়।"
উজু পুলিশ স্টেশনের আধিকারিক কমিশনার ঝাওয়ের সঙ্গেও আমরা স্থানীয় ব্যক্তির সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখি। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও জানানো হয়, ২৯ জানুয়ারি উজু শহরে এক পথ-দুর্ঘটনা ঘটে। লোকটি একটা স্কুটার চালাচ্ছিল, কিন্তু অন্যান্য গাড়িকে ঠিক মতো এড়াতে না পেরে লোকটি ভারসাম্য হারিয়ে একটা ফুটপাতের গায়ে লাগা পাথরে গিয়ে ধাক্কা মারে এবং উল্টে মাথার পিছন দিকে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত লোকটি মারাও যায়। এই দুর্ঘটনার জন্য চালক নিজেই সম্পূর্ণ দায়ী। স্থানীয় পুলিশ এবং চিকিৎসাকর্মীরা সঙ্গে-সঙ্গেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে।