২০১৯-এর লোকসভা আসনের জন্য দীর্ঘ, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবং তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর অবশেষে ভারতীয় জনতা পার্টি তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) এই ঘাঁটি থেকে ৪২টির মধ্যে ১৮টি লোকসভা আসন ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভালরকম অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে। তবে প্রাক-নির্বাচনী পর্বে রাজ্যের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা খুব তীব্র ও বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মোট ৭টি দফায় ৪২টি লোকসভা আসনের জন্য নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ওঠে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর রাজনৈতিক রণক্ষেত্র, যেখানে বিজেপি তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং তৃণমূল কংগ্রেস তার দুর্গ ধরে রাখতে মরিয়া লড়াই চালায়।
নির্বাচনী হিংসা পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যদিও টিএমসি-ই জয়লাভ করে, তবু সেই নির্বাচন অভূতপূর্ব সন্ত্রাস, হিংসা ও খুন-খারাপির দ্বারা কলঙ্কিত হয়। এ বিষয়ে আরও জানতে এখানে ক্লিক করুন। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনেও সেই হিংসা ও সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হল।
উত্তরপ্রদেশ (যে-রাজ্য লোকসভায় ৮০ জন সাংসদ পাঠায়) এবং মহারাষ্ট্রের (৪৮) পর পশ্চিমবঙ্গ লোকসভা আসনের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে, যে-রাজ্য থেকে ৪২ জন জনপ্রতিনিধি সংসদে যান। ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তারা ৪২টির মধ্যে মাত্র ২টি আসন জিততে সক্ষম হয়। তাই এবারকার নির্বাচনে তারা এ রাজ্যে আরও ভাল করতে সচেষ্ট হবে এবং দলও তার মনোযোগ ও প্রচেষ্টা এখানে কেন্দ্রীভূত করবে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল।
বিজেপির তৃনমূলের সংখ্যালঘু-তোষণের রাজনীতিকে চরম আঘাত
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে প্রায়শ সংখ্যালঘু-তোষণের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়ে থাকে। অন্য দিকে বিজেপির দ্বারা ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন চালু করা এবং তার সমর্থনে নাগরিকদের জাতীয় নথিভুক্তির প্রচার আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে নিযোজিত হয়। তার মধ্যে দ্বিতীয়টি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের বিরূপতা বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক হয় আর নাগরিকত্ব আইন হিন্দু শরণার্থীদের আশ্বস্ত করতে। একাধিকবার মোদী উল্লেখ করেন কীভাবে হিন্দুদের সরস্বতী পুজো এবং দুর্গাপুজোর উৎসব ঘুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে হিন্দু ন্যরেটিভ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পালন করেছে ভোট ব্যাঙ্কের একটি বড় অংশের সমর্থেনের পরিবর্তন হতে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শিবাশিস চট্টোপাধ্যেয়ের কথায় শোনা গেল সেই সুর, “এরাজ্যে বিজেপির উল্লেখযোগ্য উন্নতির করন সীমান্ত জেলাগুলিতে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ও তাদের হিন্দু ভোট।”
“হিন্দু ন্যারেটিভ নির্বাচনে অর্থপূর্ণ হয়েছে,” তিনি বলেন।
পরস্পরকে হেয় করার অভূতপূর্ব উদ্যোগ
১০ মার্চ নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে, পশ্চিমবঙ্গে পুরো ৭টি দফাতেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে। আর তার পরেই শুরু হয় প্রচারসভায় মমতা ও মোদীর পারস্পরিক দোষারোপের পালা। নরেন্দ্র মোদী মমতা ব্যানার্জির টিএমসিকে ‘তোলাবাজদের পার্টি’ আখ্যা দিলে মমতা সঙ্গে-সঙ্গে জবাবে মোদীকে ‘গণতন্ত্রের থাপ্পড় কষাবার’ হুমকি দেন। এখানেই শেষ নয়, রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নের রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করার জন্য মোদী মমতাকে ‘স্পিডব্রেকার দিদি’ও আখ্যা দেন। তার জবাবে মমতা আবার মোদীকে ‘ইঁটের টুকরো ও পাথরকুচি ভরা বাংলার রসগোল্লা খাওয়ানো’র কথা বলেন। বস্তুত, প্রায়শই এই দুজনের বাক-যুদ্ধ একটা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
রণাঙ্গনের বাইরের লড়াই
দু দলের প্রধানের মধ্যে এই কথার লড়াই যখন চলতে থাকে, তখন মমতা বিজেপির নির্বাচনী জনসভা বানচাল করতে বারবার সভা করার প্রশাসনিক অনুমতি আটকে দিতে থাকেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জনসভা করার কথা ছিল দক্ষিণ দিনাজপুরে, মমতার সরকার একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই সভার জন্য আদিত্যনাথের হেলিকপ্টারের নামার অনুমতি বাতিল করে দেয়। আদিত্যনাথ তখন বাধ্য হয়ে টেলিফোন মারফত সভায় সমবেত জনতার উদ্দেশে তাঁর ভাষণ দেন। এর আগে মালদা বিমানবন্দরে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের হেলিকপ্টারকেও নামার অনুমতি দেওয়া হয়নি এই অজুহাতে যে, সেখানে হেলিকপ্টার নামার পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা নেই। অমিত শাহ তখন অগত্যা একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হেলিপ্যাডে অবতরণ করতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে আরও জানতে এখানে পড়ুন। ফেব্রুয়ারি মাসে মুর্শিদাবাদ ও পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর জনসভার জন্য হেলিকপ্টার নামার অনুমতি না দেওয়ায় বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতি শিবরাজ সিং চৌহান মমতা ব্যানার্জির তীব্র সমালোচনা করেন। এ বিষয়ে আরও জানতে এখানে দেখুন।
চূড়ান্ত দ্বন্দ্বঃ অমিত শাহের রোড-শো
কলকাতায় ভোটগ্রহণের ঠিক ৫ দিন আগে, ১৪ মে শহরের কলেজ স্ট্রিট এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের রোড-শো রাস্তায় তীব্র হিংসা, সংঘাত ও অরাজকতার কারণে হঠাৎ করে কাটছাঁট করে দিতে হয়। অমিত শাহের গাড়ির কনভয় যখন কলেজ স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই বিজেপি ও টিএমসির সমর্থকরা রাস্তায় নেমে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা কালো পতাকা দেখিয়ে অমিত শাহের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকলে অমিত শাহ নিজে অক্ষত দেহে বেঁচে গেলেও দুই দলেরই বহু সমর্থক মারামারিতে ও পুলিশের লাঠি-চার্জে কমবেশি আহত হন।
বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত বিদ্যাসাগরের উপর আঘাত
কলেজ স্ট্রিটে অমিত শাহের রোড-শোর সময় যে হিংসার বিস্ফোরণ ঘটে, তা বিদ্যাসাগর কলেজে গিয়ে পৌঁছলে বঙ্গীয় নবজাগরণের পথিকৃত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দেয় কলেজ-চত্বরে প্রবেশকারী দুষ্কৃতীরা। প্রমাণের অভাবে কারা এই তাণ্ডব চালালো, তা এখনও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, তবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে এই হামলার প্রতিবাদ চতুর্দিকে ধ্বনিত হতে থাকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জি অকুস্থলে পৌঁছন এবং পরদিনই অমিত শাহ সাংবাদিক সম্মেলন করে মূর্তি ভাঙার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের গুণ্ডাদের দায়ী করেন। এ বিষয়ে আরও জানতে এখানে এবং এখানে পড়ুন।
এবং তার ফলে ঘটে প্রচারে যবনিকাপাত। বিদ্যাসাগর কলেজের অপকাণ্ডের পরেই এই প্রথম নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারের সময়সীমা ছাঁটাই করে একদিন কমিয়ে দেয়।
ভুয়ো খবরের ধারাবাহিক আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলা
এবারকার সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে ভুল খবর ও ভুয়ো খবরের বান ডেকেছিল, যার অনেকগুলোই পশ্চিমবঙ্গ-কেন্দ্রিক। বুম পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্যান্য রাজ্যের এমনকী প্রতিবেশী বাংলাদেশের একাধিক হিংসাত্মক ঘটনার ভিডিওর খোঁজ পায়, যেগুলি রাজ্যের নির্বাচনী ভুয়ো খবরের অভ্যন্তরে সাবলীলভাবে জায়গা করে নেয়। হিন্দুদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে কিংবা মুসলিমরা গণহত্যা চালাচ্ছে, এমন বেশ কিছু ফোটো ও ভিডিওর পর্দাফাঁস করে বুম, যেগুলোকে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে ও ভোটের সময় ঘটা অপকাণ্ড বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় চালানো হয়েছিল।
বামেদের বিলুপ্তি
একটি রাজ্য যা ১২ বছর আগেও বাম আধিপত্যে ছিল সাফল্যের শিখরে তারা এই নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক উদয়ন বন্দ্যোপাধায় বুম কে বলেন, “বেশ কিছু সময় ধরে বামফ্রন্ট একটা গভীর নেতৃত্ব সংকটে ভুগে চলেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সমগ্র বাম সাফ হয়ে ভোট গেছে বিজেপির ঝুলিতে।”