বুথ-ফেরত সমীক্ষা মিলে গেছে । ২০১৪ সালের জয়কেও ছাপিয়ে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি দ্বিতীয় বার কেন্দ্রে জয়ী হচ্ছে, এ বার হয়তো একাই দল ৩০০ আসন ছাপিয়ে যাবে । গত বছরের ডিসেম্বরেই হিন্দি বলয়ের যে ৩টি রাজ্যে বিজেপি কংগ্রেসের কাছে পরাস্ত হয়েছিল, সেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়েও তারা বিরোধী প্রতিপক্ষকে ভাসিয়ে দিয়েছে ।
যে উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজনসমাজ পার্টির জোট বিজেপিকে যথেষ্ট বেগ দেবে বলে মনে করা হচ্ছিল, সেখানেও বিজেপির গণভিত্তি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি । অখিলেশ যাদব-মায়াবতীর জোটের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও রাজ্যে বিজেপি ৫৭টি আসনে এগিয়ে রয়েছে ।
কিন্তু দলের সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্য পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে বিজেপি ১৮টি আসনে এগিযে । ২০১৪ সালে দল এ রাজ্যে ২টি আসনে জিতেছিল । এ বার মমতা ব্যানার্জির দুর্গে ফাটল ধরাতে ধারাবাহিক প্রচার-অভিযান চালিয়ে সেখানে ধস নামিয়েছে বিজেপি, যার পিছনে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং দলীয় সভাপতি অমিত শাহের একের-পর-এক জনসভা ।
নির্বাচনী সাফল্যে নিজের খুশি ব্যক্ত করতে মোদী টুইট করেছেনঃ
কংগ্রেসের পক্ষে এই নির্বাচন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর এক তিক্ত সমাপন l দেখানোর মতো কিছুই তার হাতে নেই, কেবল কেরলের সাফল্য ছাড়া । ২০১৪-র নির্বাচনে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন আসনসংখ্যা ৪৪-এর চেয়ে এবার হয়তো সামান্য বেশি কয়েকটি আসন জুটবে । কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো দু-দুটি আসনে-- পারিবারিক ঘাঁটি আমেথি এবং কেরলের ওয়াইনাদ থেকে-- দাঁড়ানো কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী সম্ভবত আমেথিতে স্মৃতি ইরানির কাছে হারছেন । এমনই আর একটি বিপর্যয় হল মধ্যপ্রদেশের গুনা কেন্দ্রে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার পরাজয়, যেটিও তাঁর পারিবারিক ঘাঁটি ।
একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে এবার আর এক সফল যোদ্ধার নাম অন্ধ্রপ্রদেশের জগন্মোহন রেড্ডি, যিনি বিধানসভায় জয়ী হওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের ২৫টি লোকসভা আসনের সবকটিতে চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশমকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছেন । শীঘ্রই তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও শপথ নিতে চলেছেন।
১১ এপ্রিল শুরু হওয়া নির্বাচন পর্ব এবার ৭টি দফায় ভাগ করা হয়েছিল, যার শেষ দফাটি ছিল ১৯ মে । বুথ-ফেরত সমীক্ষাতেই বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত এনডিএ-র সাফল্যের পূর্বাভাস ছিল । টাইমস নাউ-ভিএমআর সমীক্ষায় এনডিএর ৩০৬টি এবং ইউপিএ-র ১৩২টি আসনে জয়ী হবার আভাস ছিল । অন্য দলগুলির জন্য ধার্য হয়েছিল ১০৪টি আসন । আবার রিপাবলিক-সি-ভোটার সমীক্ষা এনডিএ-কে ২৮৭ এবং ইউপিএ-কে ১২৮টি আসন দিয়েছিল ।
৫৪২টি আসনের জন্য এবার ভোটগ্রহণ করা হয় এবং নির্বাচনী ইতিহাসে রেকর্ড ৬৭.১ শতাংশ ভোট পড়ে, যা ২০১৪-র ৬৬.৪ শতাংশকে ছাপিয়ে যায় ।
জাতীয় নিরাপত্তা, হিন্দুত্ব এবং মোদী—বিজেপির ত্রিফলা বিজয়মন্ত্র
২০১৪-র নির্বাচন বিজেপি জিতেছিল 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ' এই উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা, অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করা, বিদেশে জমানো কালো টাকা উদ্ধার করা এবং আন্তর্জাতিক মানের পরিকাঠামো নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে । সেখানে ২০১৯-এর নির্বাচনে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে জাতীয় নিরাপত্তা, যার ফাঁকে-ফাঁকে গুঁজে দেওয়া হয় জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান ও হিন্দুত্বকে, আর এই সবের যোগসূত্র হিসাবে কাজ করেন নরেন্দ্র মোদী ।
বিজেপি তার আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস সোশাল মিডিয়া ও মাঠ-ময়দানের প্রচারে সেই ব্যর্থতা নিয়ে মুখর হয়েছিল । রাফাল জেট বিমান কেনার চুক্তিতে শত-শত কোটি ডলারের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে 'চৌকিদার চোর হ্যায়' স্লোগানও দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছিল । কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ভোটারদের মন জয় করতে পারেনি ।
১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি সিআরপিএফ কনভয়ের উপর জঙ্গি হানা পরিস্থিতিকে বিজেপির অনুকূলে ঘুরিয়ে দেয় । অন্তত ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু গোটা দেশকে শোকস্তব্ধ করে দেয় আর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতি দেন এর সমুচিত জবাব দেওয়ারঃ প্রতিশোধের ।
হামলার এক দিন পরেই মোদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি ও তাদের মদতদাতাকে হুঁশিয়ারি দেন । বলেন—"নিরাপত্তা বাহিনীকে আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি এবং তাঁদের সাহসিকতায় আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে । ১৩০ কোটি দেশবাসীর তরফে তাঁরা এর মুখের মতো জবাব দেবেন ।"
পুলওয়ামা হামলার কিছু দিনের মধ্যেই গুজরাটে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করতে গিয়ে মোদী বলেন—'আমাদের সিদ্ধান্ত হল, ঘরের ভিতর ঢুকে গিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়ার' । সমগ্র দেশবাসী এ কথায় উজ্জীবিত হয় এবং মোদীর নামে জয়ধ্বনি উঠতে থাকে ।
পুলওয়ামা হামলার ১২ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানের ভিতর ঢুকে হামলা চালায় । পাকিস্তানের বালাকোট জেলায় বায়ুসেনার ফাইটার জেট সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ শিবিরে আঘাত হানে । এই হামলার সাফল্য এবং হামলায় নিহত জঙ্গিদের সংখ্যা নিয়ে এখনও চাপান-উতোর চলছে বটে, কিন্তু মোদী দেশবাসীকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হন যে, সিআরপিএফ জওয়ানদের হত্যার বদলা নেওয়া হয়েছে ।
বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের বিমান গুলি করে নামিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করার পরও পাকিস্তান তাঁকে নিঃশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হওয়ায় এই বার্তাও দেশবাসীর কাছে পৌঁছে যায় যে, মোদী ও তাঁর সরকার কাজ করে দেখাতে জানেন । আটক হওয়ার দুদিন পর অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়া হয় । এ জন্য আন্তর্জাতিক মহল ও গণমাধ্যম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমরান খানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও ভারতবাসীর কাছে এর পুরো কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠেন মোদী ও তাঁর সবল নেতৃত্ব ।
মোদী ও তাঁর দল বিজেপি প্রতিটি বক্তৃতায় জাতীয়তাবাদী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে থাকেন । মহারাষ্ট্রে এমনই এক বক্তৃতায় মোদী বলেন—"প্রথমবার ভোট দিতে আসা ভোটারদের কাছে আমি কি এই আবেদন জানাতে পারি যে, আপনার ভোটটা বালাকোটের অভিযানে ব্যাপৃত সাহসী বায়ুসেনার জওয়ানের উদ্দেশে এবং পুলওয়ামায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ানের উদ্দেশে উৎসর্গ করুন!"
'চৌকিদার চোর হ্যায়' থেকে 'ম্যায় ভি চৌকিদার'
২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় মোদী ও তাঁর দল সোশাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রভাব উপলব্ধি করেছিলেন এবং কাজেও লাগিয়েছিলেন, যা বিরোধীদের সম্পূর্ণ অবাক ও অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল । কিন্তু এ বারের নির্বাচনে এই নতুন প্রচারকৌশলে কংগ্রেসও তার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে । গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের আগে তারা হ্যাশট্যাগ নামায় #বিকাশগন্ধোথায়োছে (উন্নয়নের মাথা খারাপ হয়ে গেছে), আর সাম্প্রতিক পর্বে স্লোগান তোলে 'চৌকিদার চোর হ্যায়' । কিন্তু সোশাল মিডিয়ার এই যুদ্ধেও মোদী সর্বদাই কংগ্রেসের চেয়ে এক কদম এগিয়ে থেকেছেন ।
মার্চ মাসে যখন সোশাল মিডিয়ায় 'চৌকিদার চোর হ্যায়' স্লোগান রমরম করছে, তখন মোদী টুইটারে তাঁর নামের আগে 'চৌকিদার' উপসর্গটি জুড়ে দেন । অচিরেই সব বিজেপি নেতাই তাঁদের টুইটার বা অন্য সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে নিজেদের নামের আগে 'চৌকিদার' উপসর্গটি জুড়ে দিতে থাকেন । দল হিসাবে বিজেপি এবং মোদীর অনুরাগী সকলেই তাঁদের নামের আগেও 'চৌকিদার' শব্দটি জুড়তে থাকেন—যেন তাঁরাই দেশের প্রকৃত পাহারাদার ।
মোদী নিজে টুইটারে অত্যন্ত সক্রিয় । ঘন-ঘন টুইট করছেন, সেল্ফি দিচ্ছেন, আপলোড করছেন, অনুগামীদের তোলা ভিডিওর জবাব দিচ্ছেন ।
মোদী জাদু
২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি দলের অর্জন বা সাফল্য নিয়ে বিশেষ রা কাড়েনি, সবেতেই মোদীর কৃতিত্বের জয়গান গেয়েছে । প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে, ব্যানারে, বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, টুইটারে—যেখানেই দল বা সরকারের কোনও কর্মসূচির সাফল্যের বন্দনা গাওয়া হয়েছে, সর্বত্রই মোদীর মুখচ্ছবি দিয়ে তা প্রচারিত হয়েছে ।
মোদী নিজেও এ নিয়ে কোনও রকম ভাণ-ভণিতা বা রাখ-ঢাক করেননি । একের-পর-এক নির্বাচনী জনসভায় তাঁকে নিজমুখে বলতে শোনা গেছে—'মোদীকে ভোট দিন'! মহারাষ্ট্রের এক প্রচারসভায় তাঁকে বলতে শোনা গেছে—'যদি তোমরা পদ্ম চিহ্নে কিংবা তির-ধনুক চিহ্নে (বিজেপির জোটশরিক শিব সেনার প্রতীক) বোতাম টেপো, তবে জানবে সেটা সরাসরি মোদীর অ্যাকাউন্টে গিয়ে জমা পড়ছে । একই ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বিহারের একটি নির্বাচনী জনসভায় বলতে শোনা গেছে—'যদি তোমরা পদ্ম, তির কিংবা বাড়ি চিহ্নে (এনডিএ শরিকদের প্রতীক) ভোট দাও, তাহলে জানবে সেই সব ভোটই মোদীর বাক্সেই গিয়ে জমা হবে' ।
সামনে যে রাস্তা পড়ে আছে
বিজেপির দ্বিতীয় বার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়া এবং নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব স্বভাবতই অনেক কাজের ভারও বয়ে আনবে । আয়ুষ্মান ভারত-এর মতো স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প, ঘরে-ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার ও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার মতো জনমুখী প্রকল্পের প্রভাব যথেষ্ট হলেও সেগুলির সাফল্য নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয়ের কথা সোশাল মিডিয়ায় প্রায়শ দেখা যাচ্ছে ।
বিজেপি সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরার জন্য তৈরি সরকারি ওয়েবসাইট ৪৮ মাস-এ স্বভাবতই মোদী সরকারকে প্রভূত বাহবা দেওয়া হয়েছে । তাতে নথিভুক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২২ মে পর্যন্ত দেশের ৩৫ কোটি ৬৫ লক্ষ মানুষ জনধন যোজনার সুফল পেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ১ কোটি ৫৩ লক্ষ মানুষকে পাকা বাড়ি গড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সৌভাগ্য প্রকল্পে ২ কোটি ৬২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৩৫০টি বাড়িতে বিদ্যুদয়ন করা হয়েছে ।