এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ উত্তর প্রদেশের হাথরসে পুলিশের দ্বারা ১৯ বছরের এক দলিত মেয়ের দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে সুয়ো মটো বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারের জন্য গ্রহণ করেছে। ওই মেয়েটিকে তাঁরই গ্রামের চার উচ্চবর্ণের পুরুষ গণধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ। নির্যাতিতার শরীরে যৌন নিগ্রহের চিহ্ন বা তাঁর জিভ কেটে ফেলার দাবি অস্বীকার করেছে হাথরসের পুলিশ সুপার।
১ অক্টোবর, হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য ও পুলিশ প্রশাসন এবং মৃতের পরিবারের সদস্যদের ১২ অক্টোবর ঘটনার সব তথ্য জমা দিতে বলেছে।
১১ পাতার এক আদেশে, হাইকোর্ট বলেছে বিষয়টি "সাধারণের জন্য এবং জনস্বার্থের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ"। কারণ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে জুলুমের অভিযোগ উঠেছে এই ঘটনায়, যার ফলে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
নির্যাতিতার মৃত্যুর পরের ঘটনাবলি, "যা তাঁকে দাহ করার মধ্যে দিয়ে চুড়ান্ত রূপ নেয়", তা "আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।" প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে কোর্ট বলে যে, হাথরসের ঘটনা ও মধ্যরাতের পর দেহ পোড়ানোকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাবলির কথা জানা গেছে, তা যদি সত্যি হয়, তা হলে সেগুলিকে ওই পরিবারের যন্ত্রণা প্রলম্বিত করা ও তাঁদের "ক্ষতে নুনের ছিটে দেওয়ার সমান" বলে গণ্য করতে হবে।
২৯ সেপ্টেম্বর, হাথরসে ইউপি পুলিশের জুলুম ও তার পরের ঘটনাগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তা হল, পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও মৃতদেহ দাহ করার অধিকার কি পুলিশের আছে?
উত্তর হল—না, পুলিশের সেই অধিকার নেই।
মৃতদেহের ওপর অধিকার কার?
পঞ্জাব পুলিশ রুলস, ১৯৩৪ (এই রুল দিল্লি পুলিশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিন্তু ইউপি পুলিশের ক্ষেত্রে নয়) অনুযায়ী, "তাঁর পরীক্ষার কাজ শেষ হয়ে গেছে, সিভিল সার্জেন এ কথা জানানর পর পুলিশ দেহ মৃতের পরিবার বা বন্ধুদের হাতে তুলে দেবে, যদি না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভিন্ন আদেশ থেকে থাকে..."
'মেডিকো-লিগাল' কেসে বা যে সব চিকিৎসার ব্যাপারে আইনি জটিলতা থাকে, সেই সব ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হলে, ডাক্তাররা পোস্ট-মর্টেম করেন। এবং অনুমতি পাওয়ার পর রোগীর দেহ তাঁর আত্মীয়দের হাতে তুলে দেন। মুম্বাইয়ের এক প্রথম সারির হাসপাতালের ডিন বুমকে এ কথা বলেন। "একমাত্র নভেল করোনাভাইসের কারণে মৃত্যু হলে, মরদেহ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়," উনি জানান।
কোনও দেহ যদি মৃতের আত্মীয়/বন্ধুরা দাবি না করে, তাহলে জেলা শাসকের নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেই দেহ সমাধিস্থ বা দাহ করে পুলিশ।
বেওয়ারিস লাশের ক্ষেত্রে, তদন্তকারী অফিসারকে দেহের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ নথিভুক্ত করতে হয়। তাতে দেহের সব রকমের দাগ, অস্বাভাবিকতা, বিকলাঙ্গতা, বৈশিষ্ট্য ও আঙ্গুলের ছাপ নথিভুক্ত করে দেহ শনাক্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা চালাতে হয় তাঁকে।
অনেক সময় খবরের কাগজে পুলিশ মৃতদেহের ছবি বিজ্ঞাপিত করে এবং জনসাধারণকে সেগুলি শনাক্ত করার আবেদন জানায়।
বুমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইন্দিরা জয়সিং এই নিয়মটিরই পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এক মাত্র মৃতের পরিবার বা তাঁর নিকট আত্মীয়রাই দেহ পাওয়ার অধিকারী। হাথরাসের ঘটনা সম্পর্কে জয়সিং বলেন, "সব আইনি কাজ সাফদার জং হাসপাতালেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিৎ ছিল। এবং তারপর মরদেহ আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারত। পুলিশের হাতে দেহ তুলে দেওয়ার আমি কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। তারা দেহটির মালিক নন। অপরাধের তদন্তের স্বার্থে ছাড়া কারও মরদেহের ওপর রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই। এবং সাফদার জং হাসপাতাল থেকে মরদেহ ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।"
আরও পড়ুন: ভারতের হিন্দি বলয়ে গণধর্ষণ একটা বড় সমস্যা
মরদেহও মর্যাদার অধিকারী
ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি যে মৌলিক অধিকারের অধিকারী একটি মরদেহের ক্ষেত্রেও সেই অধিকার প্রযোজ্য। ১৯৫৫ সালে, পরমানন্দ কোটারা মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্ট বলে, "ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, একজন জীবিত ব্যক্তি যে মর্যাদা ও ন্যায্য আচরণ পাওয়ার অধিকারী, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।"
২০০২ সালে, আশ্রয় অধিকার অভিযান মামলায় পুলিশ আধিকারিকরা ও প্রশাসন যে ভাবে এক আশ্রয়হীন মৃত ব্যক্তির ধর্মের নিয়ম মেনে তাঁকে সমাধিস্থ করেন, সুপ্রিমকোর্ট সে কাজকে স্বীকৃতি দেয়।
২০০৭ সালে, এস সেতু রাজা বনাম মুখ্য সচিব মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, "আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী, একজন জীবিত ব্যক্তি যে ধরনের মানবিক মর্যাদা আশা করতে পারেন সেই একই (বা তারও বেশি) মর্যাদা মৃত ব্যক্তিকে দেখানর কথা।"
একজন আবেদনকারীর ছেলের মরদেহ মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করার নির্দেশে সুপ্রিমকোর্ট আরও বলেন, "এ বিষয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই যে, বিদেশে মারা-যাওয়া ছেলের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার যে আকাঙ্খা একজন পিতা অনুভব করেন, তার পেছনে সেই সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে যে ব্যক্তির আত্মা তখনই শান্তি পায় যখন তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ হয় বা দাহ করা হয়।"
ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার দেয়। তার মধ্যে সৎকার সংক্রান্ত ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিও পড়ে।
আইনজীবী শোভা গুপ্ত বলেন, হাথরাসের ঘটনায় যে ভাবে পুলিশ মৃতের দেহ পুড়িয়ে দেয়, তা অস্বাভাবিক। "পরিবারের কাছ থেকে মরদেহ নিয়ে তা পুড়িয়ে দেওয়ার কী অধিকার ছিল পুলিশের?" সেই প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী গুপ্ত।
উনি গুজরাট ধর্ষণ কাণ্ডে বিলকিস বানোর হয়ে সওয়াল করে ছিলেন। "হাথরাসে মাঝরাতে যা ঘটল তা সৎকার নয়, শ্রেফ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা। আমরা আমাদের পোষ্যদের সঙ্গেও এমন আচরণ করি না। করি কি? তারা যা করেছে, তেমন ঘটনা কোনও সভ্য সমাজে শোনা যায় না। পুলিশ তার সমস্ত ক্ষমতা ফলিয়েছে। ভগবান জানেন কোথা থেকে তারা এত ক্ষমতা পেলেন...তবে ওই কাজকে শেষকৃত্য, দাহ বা অন্তিম সংস্কার বলা চলে না," বলেন অ্যাডভোকেট গুপ্ত।
আরও পড়ুন: না, এটি হাথরসে প্রয়াত নির্যাতিতার ছবি নয়