দুটি পরস্পর সম্পর্কহীন ভিডিও, যার একটি বাংলাদেশের, অন্যটি রাজস্থানের হিংসাত্মক ঘটনার ছবি তুলে ধরে, সে-দুটিকে দুরভিসন্ধি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একসঙ্গে শেয়ার করে প্রচার করা হয়েছে যে, রাজস্থানের রানিপুরা গ্রামে একটি হিন্দু মন্দিরের উপর মুসলিমদের হামলার ছবিই নাকি এতে তুলে ধরা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবে এই ভিডিও দুটি ভাইরাল করা হয় একটি হিন্দি ক্যাপশন দিয়ে: “রাজস্থানের রানিপুরায় হিন্দুরা মার খাচ্ছে, তাদর মন্দির ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, তাদের মহিলা ও শিশুদের পেটানো হচ্ছে। ভিডিও দুটি যথাসম্ভব শেয়ার করুন। জয় শ্রী রাম!”
প্রথম ভডিওটি ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতীয় সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, টুপি-পরা একদল মুসলিম হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে লাল ইঁটের একটি কাঠামো এবং কাছাকাছি একটি বাড়িতে ভাঙচুর করছে।
সম্প্রতি বাংলাতেও ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। পোস্টটিতে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, ‘হিন্দুদের ওপর ইমামের লুট ধর্ষণ ভাঙচুর ।
না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।’ পোস্টটি আর্কইভ করা আছে এখানে।
বুম এই ভিডিওটিকে অনেকগুলি ফ্রেমে ভেঙে খোঁজ চালিয়ে দেখেছে, ভারতে ভাইরাল হওয়ার আগে এটি বাংলাদেশের লোকেরা বাংলা বিবরণী সহ ইউটিউবে আপলোড করেছিল।
ফেসবুকে আমরা এই একই ভিডিও বাংলা বিবরণী সহ আপলোড হতে দেখেছি ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। তাতে লেখা: “ওরা জিন্দা পীরের নামে একটি মাজার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ ভাবেই আমাদের দেশে সব পীরের মাজার ভেঙে দেওয়া উচিত।”
ভিডিওটির মাঝামাঝি জায়গায় একজনকে চিৎকার করে বলতে শোনা যাচ্ছে, “ছেলেটাকে সরাও,” ঠিক যথন একটি টিনের চালা তার মাথার উপর ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
একই ভিডিও ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ডঃ জাকির নায়েক পিস টিভি বাংলা নামের একটি ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়।
বাংলাদেশের এক স্থানীয় রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলে বুম জেনেছে, রক্ষনশীল ইসলামে কোনও ব্যক্তির স্মৃতিসৌধকে ইসলাম-বিরোধী বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ থেকে পোস্ট হওয়া এই ভিডিওটির প্রেক্ষাপট ঠিক কী ছিল, তা বুম স্বাধীনভাবে যাচাই করে উঠতে পারেনি। তবে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, এটি রাজস্থানের কোনও ঘটনার ভিডিও নয়।
২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বুম রাজস্থানের বুঁদি জেলার পুলিশ সুপার যোগেশ যাদবের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে জানতে চায়, ভিডিও দুটিতে দেখানো ছবি রাজস্থানের রানিপুরার কোনও ঘটনার কিনা। তাতে যাদব আমাদের জানান, ভিডিও দুটি তাঁরও নজরে এসেছে, তবে এগুলির সপক্ষে তিনি কোনও প্রমাণ পাননি।
যাই হোক, যাদব দ্বিতীয় ভিডিওটি সম্পর্কে সে সময় বিশেষ কিছু বলতে পারেননি। বুম-ও ইউটিউবে আপলোড হওয়া দ্বিতীয় ভিডিওটির প্রেক্ষিত সম্পর্কে কোনও সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পায়নি।
দ্বিতীয় ভিডিওটিতে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা ইঁটের মাঝখানে স্তব্ধবাক এক মহিলাকে বিলাপ করতে করতে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আরও কয়েকজন মহিলা।
ভিডিওটি নিয়ে খোঁজখবর করতে এবিপি নিউজ তার রিপোর্টারকে রাজস্থানের রানিপুরা গ্রামে পাঠায়। গ্রামবাসীরা রিপোর্টারকে জানান, এলাকায় কোনও মন্দির আক্রান্ত হয়নি। এবিপি নিউজ ভাইরাল সচ জানায়, ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এক পূজারীর বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হয়। তাতে বাড়ির যে অংশটা এবং একটি টয়লেট বাইরে নির্মাণ করা হচ্ছিল, সেটি ভাঙা পড়ে। এবিপি জানায়, প্রজাপতি সম্প্রদায়ের সদস্যরা দেবত্তোর সম্পত্তির উপর একটি স্থায়ী কাঠামো নির্মিত হতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে সেটি ভেঙে দেয়। ভিডিওতে যাদের হাত-পা ছড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে, তারা সকলেই রঘুনাথ মন্দিরের পূজারীর পরিবারের সদস্যা। (এবিপি ভাইরাল সচ ভিডিওর ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড থেকে দেখুন)
বুঁদি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দশরথ সিং জানান, পূজারীর পরিবারের রঘুনথ মন্দিরে পুজো করা নিয়ে স্থানীয়দের কোনও আপত্তি ছিল না, তাদের আপত্তি কেবল সেখানে একটি স্থায়ী কংক্রিটের কাঠামো তৈরি নিয়ে।