না, এই ভিডিওটি প্রকাশ্যে আফগানদের তালিবানের কোতল করার দৃশ্য নয়
বুম দেখে ভিডিওটি আসলে ২০১৯ সালের কাবুলে একটি পথ-নাটিকার দৃশ্য যেখানে জলরেজ অঞ্চলে তালিবানি অপরাধের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
ময়দাব ওয়ারদাক প্রদেশের জলরেজ (Jalrez) অঞ্চলে তালিবানি (Taliban) নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাবুলে সমাজকর্মী ও নাট্যকর্মীদের মিলিত প্রয়াসে একটি পথ-নাটিকার আয়োজব করা হয় ২০১৯ সালে, যার ভিডিও ফুটেজকে সাম্প্রতিক এবং সত্য ঘটনার ছবি বলে ভাইরাল করা হচ্ছে। বুম দেখেছে, পথ-নাটিকাটিতে নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মীরা তুলে ধরেছেন, কী ভাবে জলরেজ এলাকার সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপর তালিবান জঙ্গিরা মোটরযান চালকদের অপহরণ ও হত্যা চালিয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখে।
গত এপ্রিলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্থাৎ আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের ঠিক ২০ বছর পর যাবতীয় মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকেই তালিবান বাহিনী দ্রুত গতিতে হেরাট ও কাবুল সহ আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
আরও পড়ুন: জনমতে রাজ্যে এগিয়ে তৃণমূল, গ্রাফিকটি ভুয়ো জানাল হেডলাইনস ত্রিপুরা
৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী ভিডিওটিতে মুখোশ-পরা তালিবান জঙ্গিদের পোশাকে সজ্জিত অভিনেতাদের এক টেম্পো দাঁড় করিয়ে তার চালককে বন্দুকের নলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে আসতে হুকুম দিতে দেখা যাচ্ছে। এর পরেই ওই অভিনেতাদেরই দেখা যাচ্ছে অন্য একটি গাড়ি লক্ষ্য করে নকল গুলি ছোঁড়ার অভিনয় করতে এবং সেই গাড়ির আহত যাত্রীদের এক-এক করে নামিয়ে রাস্তায় পাশাপাশি শুইয়ে রাখতে, যেন তারা সব গুলিতে মারা গেছে। পুরো সময়টা ধরেই দেখা গেছে ক্যামেরাম্যানরা ঘটনাটির ছবি তুলে রাখছে।
বুম-এর হোয়াটঅ্যাপ হেল্পলাইন নম্বরেও ভিডিওটি পাঠিয়ে তার দাবির সত্যতা যাচাইয়ের অনুরোধ এসেছে।
দৃশ্য দেখাল ক্যালকাটা নিউজ
বুম দেখে পথনাটিকার ওই অংশের একই দৃশ্য তাদের রিপোর্টে দেখায় বাংলা গণমাধ্যম ক্যালকাটা নিউজ। প্রথম ৪ সেকেন্ড সময়ে দেখানো হয় ওই দৃশ্যটি। ভিডিওটি দেখা যাবে এখানে।
সম্পূর্ণ ভিডিওটি নিচে দেখুন
ভিডিওটিতে আমরা ইংরাজি ও আরবি শব্দ দিয়ে বানানো একটি লোগো বা প্রতীক নজর করেছি। গুগল লেন্স ব্যবহার করে আমরা লোগোটির অনুবাদ করি এবং দেখি সেটি হল আফগান ইন্টারন্যাশনাল, এবং ইউ-টিউবে খোঁজ লাগিয়ে আমরা ওই একই নামের একটা চ্যানেলেরও খোঁজ পাই।
ইউটিউবের চ্যানেলটি ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ওই একই ভিডিও আপলোড করেছিল, আরবি ভাষায় যার ক্যাপশন দেওয়া হয়েছিল— "দেখুন কী ভাবে জলরেজ এলাকায় তালিবান গোষ্ঠী যাত্রীদের ঘিরে ফেলছে! শিল্পীদের কী ভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছে, তারই একটা প্রতীকী দৃষ্টান্ত!"
আরও পড়ুন: সিরিয়ায় এক মহিলাকে প্রকাশ্যে খুন করার ভিডিও আফগানিস্তানের বলে ছড়াচ্ছে
ইউটিউবের ওই চ্যানেলটির পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে, "২০১৯ সালে কয়েকজন সৃজনশীল তরুণ বিজ্ঞানভিত্তিক, গবেষণামূলক, শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার উদ্দেশ্যে এই চ্যানেলটি চালু করেন।"
এরপর আমরা ভিডিওটির কয়েকটি মূল ফ্রেম নিয়ে তার সঙ্গে আরবি ভাষায় জলরেজ শব্দটি জুড়ে অনুসন্ধান চালাই এবং এটিলাট্রোজ নামে একটি আফগানিস্তান-ভিত্তিক সংবাদ-চ্যানেলে একটি প্রতিবেদনও খুঁজে পাই। এই প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় এবং তাতে ওই পথ-নাটিকারই দৃশ্যটিও রয়েছে।
আমরা এটিলাট্রোজ-এর প্রধান সম্পাদক জাকি দারিয়াবি-র সঙ্গেও যোগাযোগ করি এবং টুইটার কথোপকথনে তিনিও স্বীকার করেন যে, দৃশ্যটি আসলে একটি নাটকের দৃশ্য, "এটি কাবুলের একটি থিয়েটারের দৃশ্য। ওঁরা দেখাতে চাইছিলেন, ময়দান ওয়ারদাক প্রদেশের জলরেজ জেলায় হাজারা জনজাতির সঙ্গে কেমন আচরণ করা হচ্ছে।"
প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছিল, জলরেজ থেকে কাবুল-মারকাজি হাইওয়ে ধরে যাতায়াতকারী যাত্রীরা নিয়মিত তালিবানের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং তাঁদের অনেককে অপহরণ ও খুনও করা হয়। বস্তুত, এই হাইওয়েটি ক্রমে 'মৃত্যুর পথ' বলে পরিচিত হতে থাকে। ২০১২ সাল থেকে রাজধানী থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জলরেজ জেলায় তালিবান ১০৮ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে, যাদের অধিকাংশই অসামরিক নাগরিক এবং যাদের গুলি করে কিংবা শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। এর বাইরেও ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী বেশ কয়েক ডজন লোককে তালিবান হেনস্থা করেছে বা অপহরণ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ১ সেপ্টেম্বর তালিবান জঙ্গিরা শত-শত পরিবারের ওপর হামলা চালায়, বিশেষত হাজারা জনজাতি-অধ্যুষিত সারচেসমে ও পিতাব এলাকায় এবং এই সব অঞ্চলে যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতা ঘনিয়ে তোলে।
হাজারা জনজাতি একটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা এবং তারা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত তালিবান ও ইসলামিক স্টেট সমর্থকদের দ্বারা নিয়মিত নির্যাতিত হয়েছে।
আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান সংঘাত সোশাল মিডিয়ায় রকমারি ভুয়ো খবরের প্রসার ঘটিয়েছে, এমনকী দেশের দখল নেওয়ার আগে তালিবান জঙ্গিরা মুখোশ পরে ঘুরছিল বলে ব্যঙ্গাত্মক পোস্টও ছড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পুরনো ছবি ও ভিডিও ফুটেজকে সাম্প্রতিক ঘটনার দৃশ্য বলেও ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন: লন্ডনে ২০১৪ সালের এক পথনাটিকার ছবি আফগানিস্তানের বলে চালানো হল