ভারত-পাক সংঘাতের আবহে, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ গণমাধ্যমে ভুয়ো তথ্যের সঙ্গে
বুম দেখে একাধিক অসম্পর্কিত দৃশ্য বিভ্রান্তিকর দাবিসহ অপারেশন সিঁদুর ও তার পরবর্তী সামরিক ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে যোগ করে সম্প্রচার করা হয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলিতে।

অপারেশন সিঁদুরের (Operation Sindoor) মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার নয়টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার পর, গত ৮ ও ৯ মে রাতে ভারত (India) ও পাকিস্তানের (Pakistan) মধ্যে সামরিক আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ শেষ কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আকার ধারণ করে। এই পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলি (mainstream media) বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন দাবি সম্প্রচার করে।
এক্সক্লুসিভ দৃশ্য তুলে ধরার দৌড়ে কখনো গাজা (Gaza), কখনো মুম্বইয়ের ধারাভি (Dharavi), কখনো ফিলাডেলফিয়া (Philadelphia) আবার কখনো এআই (AI) প্রয়োগে তৈরি ভিডিও পাকিস্তানের বলে জায়গা করে নেয় প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে। এছাড়াও, পাক সেনা প্রধান আসিম মুনিরের (Asim Munir) অপসারণ থেকে করাচি বন্দর (Karachi port) ধ্বংসের মতো দাবি কোনও যাচাইকৃত সরকারি অনুমোদন ছাড়াই জায়গা করে নেয় সরাসরি সম্প্রচারগুলিতে।
বুম সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এমন একাধিক দাবি যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে সেগুলি বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন।
প্যালেস্টাইনের গাজায় ইজরায়েলের হামলা হল পাকিস্তানে অপারেশন সিঁদুরের এক্সক্লুসিভ
৭ মে মধ্যরাতে ভারতীয় সেনার অপারেশন সিঁদুরের এক্সক্লুসিভ দৃশ্য হিসাবে রাতের আকাশে বিস্ফোরণের ক্লিপ সম্প্রচার করে রিপাব্লিক বাংলা।
তবে, শুধু রিপাব্লিক বাংলাই নয়, এবিপি আনন্দ, নিউজ১৮ বাংলা ও টিভি৯ বাংলাও একই ভিডিও সম্প্রচার করে।
বুম যাচাই করে দেখে ভিডিওটি ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবরে গাজায় ইজরায়েলের করা বিমান হানার এবং ভারত-পাক সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত। দেখুন এখানে।
টিভি৯ বাংলায় এক্সক্লুসিভ বিস্ফোরণের দৃশ্য কী আদৌ শিয়ালকোটের?
পর পর বিস্ফোরণ থেকে রাতের আকাশ লাল করে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ আগুনের ক্লিপ ৮ মে, ২০২৫ তারিখে শিয়ালকোটের এক্সক্লুসিভ হিসাবে সম্প্রচার করা হয় টিভি৯ বাংলায়। সংবাদমাধ্যমটি আরও দাবি করে তারা বালুচ বিদ্রোহীদের সূত্র মারফত ভিডিওটি পেয়েছে।
তবে, বুমের অনুসন্ধান তুলে ধরে অন্য এক তথ্য। আমরা ভিডিওটির কিফ্রেমের রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখি শিয়ালকোট বা পাকিস্তানের অন্য কোনও জায়গারই নয় ভিডিওটি বরং সেটি মুম্বইয়ের ধারাভির।
এবছরের ২৫শে মার্চ, ধারাভি এলাকায় কুড়িটিরও বেশি এলপিজি সিলিন্ডারবাহি একটি ট্রাকে লিক থেকে আগুন লেগে পর পর বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আমরা তুলনা করে দেখি ধারাভির আগুনের উপলব্ধ ভিডিওর সঙ্গে সম্প্রচারিত ক্লিপটি মিলে যায়।
আইএনএস বিক্রান্তের করাচি বন্দর ‘তছনছ’ ও আসিম মুনিরের অপসারণের দাবি সম্পূর্ণ ভুয়ো
৮ ও ৯ মে অন্তর্বর্তী রাতে, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ তুঙ্গে, সেসময় এবিপি আনন্দ ও টিভি৯ বাংলার মতো সংবাদমাধ্যমে একটি রাস্তার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কিছু ধ্বংসাবশেষের দৃশ্য করাচি বন্দরের বলে সম্প্রচার করা হয়। সমাজমাধ্যমেও একই দৃশ্য ভাইরাল হয়।
বুম যাচাই করে দেখে ভিডিওটি আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার একটি বিমান দুর্ঘটনার। এছাড়াও, আমরা করাচি পোর্ট ট্রাস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছি ক্লিপটি করাচি বন্দরের নয়।
উপরন্তু, ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক তাদের প্রেস বিবৃতিতে কোথাও পাকিস্তানের উপর আইএনএস বিক্রান্তের হামলার উল্লেখ করেনি।
৮ মে রাতে এবিপি আনন্দ দাবি করে পাক সেনা প্রধান আসিম মুনিরকে অপসারন করা হয়েছে।
তবে, প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আমরা একাধিক সংবাদ প্রতিবেদনে দেখি, আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস করা সম্পর্কে পাকিস্তানের সেনা প্রধানের সঙ্গে কথা বলে ১০ মার্চ, ২০২৫ তারিখে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয়, পাকিস্তানের সেনা প্রধান হিসাবে আসিম মুনিরকেই উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন এখানে ও এখানে।
নিউজ১৮ বাংলায় জায়গা পেল পাক আইএসপিআর প্রধান শরিফ চৌধুরির ভাইরাল ডিপফেক
ভাইরাল ভিডিওটিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে শরিফ চৌধুরীকে অপারেশন সিঁদুরের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনার বিষয়ে কথা বলার পর, ভারত দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছে বলতে দেখা যায়।
সংবাদমাধ্যম নিউজ১৮ বাংলা ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখে, "India vs Pakistan : যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের কথা স্বীকার পাক সেনার।"
বুম যাচাই করে দেখে শরিফ চৌধুরির ২০২৪ সালের একটি সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্যের উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ভিডিওটি তৈরি করা হয়। ইউসি বার্কলেতে সিনথেটিক মিডিয়ায় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হ্যানি ফারিদ ই-মেল মারফত বুমকে নিশ্চিত ভাবে জানান ডিপফেক এই ভিডিওয় এআই ভয়েস ব্যবহৃত হয়েছে। পড়ুন এখানে।
প্রসঙ্গত, ভারত সরকার এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে দেশের নাগরিকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয় এবং সমাজমাধ্যমে ভারত সম্পর্কে পাকিস্তানের ছড়ানো ভুয়ো তথ্যের প্ররোচনায় না পড়ার পরামর্শ দিয়েছে।