রাম মন্দির ভূমি পূজা: আইনি লড়াইয়ের ঘটনাক্রম যা নিষ্পত্তি ঘটায় বিবাদের
অযোধ্যায় মহাসমারোহে হয়ে গেল রাম মন্দিরের ভূমি পূজা। শতাব্দী প্রাচীন বিবাদকে ঘিরে এই হল আইনি জটিলতার ঘটনাক্রম।
এক যুগান্তকারী অনুষ্ঠানে, ৪০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি রূপোরইঁট স্থাপন করে রাম মন্দিরের নির্মাণ কাজের সূচনা করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা পৌঁছেছেন।
এই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে, ১ অগস্ট, অযোধ্যার জেলা প্রশাসন সরকারিভাবে শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্টের তত্বাবধানে থাকা রাম লালা বিরাজমানের নামে ২.৭৭ একর জমি হস্তান্তর করে। এই ট্রাস্টের কর্ণধার হলেন তার সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই।
রাম মন্দির নির্মাণের সূচনার তাৎপর্য হল ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম জমি সংক্রান্ত বিবাদের অবসান। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েক শতাব্দী-পুরনো এই বিবাদ ভারতের রাজনীতির ধারাকে কয়েক দশক ধরে প্রভাবিত করে এবং ১৯৯২ সালের বম্বের দাঙ্গার মতো স্বাধীন ভারতের অন্যতম ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাম মন্দিরের নির্মাণ ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক জয়েরও প্রতীক, কারণ ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনী ইস্তেহারে রাম মন্দির গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: টাইমস স্কোয়ারের বিলবোর্ডে হিন্দু দেবতা রামের এই ছবিটি ফটোশপ করা
৫ অগস্টের অনুষ্ঠান পর্যন্ত যে যাত্রাপথ, তা কখনওই সুগম ছিল না। কয়েক শতাব্দী-পুরনো বিবাদটি শুরু হয় ১৫২৮ সালে, যখন একটি মসজিদ তৈরি হয় এমন এক জায়গায় যেটিকে ভগবান রামের জন্মস্থান বলে মনে করা হত। এবং অবশেষে সেই বিবাদের অবসান হয় ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে, যখন এক ঐতিহাসিক জাজমেন্টে, সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুদের পক্ষে রায় দেয়।
ওই মামলায় কম করে ৫২ পক্ষ জড়িয়েছিলেন। তাঁদের হয়ে ১৮ জন প্রবীণ অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বে সওয়াল করেন ২০০ আইনজীবী। উচ্চতম আদালত ৫৩৩টি প্রদর্শিত জিনিস যাচাই করে দেখে। তার মধ্যে ছিল মৌখিক জবানবন্দি, শদাব্দী-প্রচীন পুঁথি, লিখিত দস্তাবেজ ও আসল লেখা মুছে তার জায়গায় নতুন বয়ান বসানো দলিল। তা ছাড়াও পালি, সংস্কৃত, আরবি, গুর্মুখি, এবং ফার্সি থেকে অনুবাদ করা ৯,০০০ পাতার পাণ্ডুলিপিও সুপ্রিম কোর্টের কাছে পেশ করা হয়।
রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ জমি বিবাদটি কী?
মূলত সেটি হিন্দু ও মুসলমান গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি বিবাদ। যে ২.৭৭ একরের ওপর বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল, হিন্দুরা সেটির দখল পাওয়ার দাবি তোলেন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে, ১৬ শতাব্দীতে তৈরি ওই মসজিদ কর সেবকরা ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
ওই বিবাদ প্রথম আদালতে ওঠে ১৮৮৫ সালে। মসজিদের স্থাপত্যের বাইরে একটি শামিয়ানা খাটানর অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন মহন্ত রঘুবীর দাস। কিন্তু ফৈজাবাদের জেলা আদালত তা খারিজ করে দেয়। বিষয়টি আবার আদালতে ওঠে ১৯৪৯ সালে, যখন ভক্তরা রাম লালা বা শিশু ভগবান রামের মূর্তি মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের নীচে বসিয়ে দেন।
১৯৫৯ সালে, জমির সম্পূর্ণ দখল চেয়ে নীলমনি আখড়ার তরফ থেকে মামলা করা হয়। দু'বছর পর, ১৯৬১ সালে, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকাফ বোর্ড পাল্টা মামলা করে দখল দাবি করে। কয়েক বছর ধরে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে, বিষয়টি ১৯৮৯ সালে এলাহাবাদ হাই কোর্টে এবং ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়।
এলাহাবাদ হাই কোর্ট কি বলে?
প্রায় ২০ বছর ধরে এলাহাবাদ হাই কোর্ট মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়টিকে নানান দিক থেকে খতিয়ে দেখে। অবশেষে, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে, ওই কোর্টের তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চ ২:১ ভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে, জমিটিকে নীলমনি আখড়া, সুন্নি ওয়াকাফ বোর্ড ও রাম লালার মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেন।
বিষয়টি আসে সুপ্রিম কোর্টে
৯ মে ২০১১ তে সুপ্রিম কোর্ট এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে। সেই থেকে বিষয়টি এক প্রকার হিমঘরে চলে যায়। কিন্তু ২০১৬ সালে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তাঁর পুজো করার মৌলিক অধিকার কার্যকর করার জন্য "রাম মন্দিরের পুননির্মাণ" দাবি করেন। ফলে, বিষয়টি আবার জিইয়ে ওঠে। উচ্চতম আদালতে স্বামীর আর্জির পরেই, সেখানে একরাশ আবেদন, পাল্টা আবেদন এবং হস্তক্ষেপ করার আর্জি জমা পড়ে। সেই সময় আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের উত্তেজনার আবহাওয়ায় বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চেয়ে যে সব আবেদন জমা পড়েছিল, ১৪ মার্চ ২০১৮ তে সুপ্রিম কোর্ট সেগুলি খারিজ করে দিয়ে কেবল আসল বিবাদিদের আবেদন শোনার সিদ্ধান্ত নেয়।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, বিষয়টি এই প্রথম সুপ্রিম কোর্টে আসে, তা নয়। জমির মালিকানা নির্ণয় করা ছাড়াও, 'অ্যাকুইজিশন অফ সারটেন এরিয়াজ অ্যাট আয়োধ্যা অ্যাক্ট' (অযোধ্যায় কিছু জমি অধিগ্রহণ করার অ্যাক্ট) চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি রিট পিটিশন বিচার করে দেখে কোর্ট। সেই সময়, ওই আইনের বলে, নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বিতর্কিত এলাকায় ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৪ সালে, কোর্ট আইনটির সাংবিধানিক বৈধতার পক্ষেরায় দেয়। এবং একই সঙ্গে ইসমায়েল ফারুকি মামলায় কোর্ট বলে যে, মসজিদ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়।
আরও পড়ুন: ২০১৮'র ঢোল-তাসা বাজানোর ভিডিওকে বলা হলো রাম মন্দির স্থাপনের উদযাপন
দীর্ঘ সময়কালে, বিবাদটি কোর্টের বাইরে মিটিয়ে নেওয়ার অন্তত ন'বার চেষ্টা হয়।
ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ২৬ ফেব্রুয়ারি বলেন, "যেহেতু বিবাদটা কারওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে নয়, তাই আলোচনার মাধ্যমে এটিকে মিটিয়ে ফেলার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করতে চাই।" পাঁচ বিচারচতির যে সাংবিধানিক বেঞ্চ এই মামলা শুনছিলেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি গগোই। বর্তমান প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এস.এ. বোবডে, যিনি ওই বেঞ্চের একজন সদস্য ছিলেন, বলেন, "সুষ্ঠ নিষ্পত্তির যদি এক শতাংশ সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে তা আমাদের চেষ্টা করে দেখতে হবে।"
সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে, সাংবিধানিক বেঞ্চ মামলাটি ৬ অগস্ট ২০১৯ থেকে শুনতে আরম্ভ করে। ৪০দিনের এক ম্যারাথন শুনানির শেষে, জমি সংক্রান্ত ওই বিবাদের অবসান হয়। যখন, ৯ নভেম্বর ২০১৯-এ শীর্ষ আদালত এক সর্বসম্মত রায়ে, হাইকোর্টের ফয়সালা খারিজ করে দিয়ে, জায়গাটির সম্পূর্ণ দখল রাম লালাকে প্রদান করে। রাম মন্দির নির্মাণের কাজের তদারকি করার জন্য শীর্ষ আদালত কেন্দ্রকে একটি ট্রাস্ট গঠন ও ওয়াকাফ বোর্ডকে ৫ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
আরও পড়ুন: রামায়ণের গল্পের ওপর ২০১৭ সালে প্রকাশিত ডাক টিকিট সাস্প্রতিক বলে ভাইরাল