এডওয়ার্ড মরড্রেক ও দুমুখো মানুষের গুজব
বুম দেখে এক কল্পকাহিনীকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এডওয়ার্ড মরড্রেক মিথ আর ভাইরাল ছবিগুলি তাকে রূপ দেওয়া নিছক শিল্পকর্ম।
ফেসবুকে এডওয়ার্ড মরড্রেক ওরফে এডওয়ার্ড মরডেক নামে এক কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে শিল্পকর্মের দুটি ছবির একসেট পোস্ট করে এক মনগড়া গল্পের গুজব শেয়ার করা হচ্ছে। ওই ভুয়ো পোস্ট গুলিতে দাবি করা হচ্ছে এডওয়ার্ড মরড্রেক নামে ১৯ শতকে এক দুমুখো মানুষের জন্ম হয়। একই মাথায় দুটি মুখ দুরকম আচরণ করতে চাইতো। পরে তিনি ডাক্তারদের শরনাপন্ন হন অস্ত্রপচারের জন্য। কিন্তু কেউই সাহস করে ওই মাথার অস্ত্রপচারে সম্মত না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি আত্মহত্য করেন।
ফেসবুক পোস্টির একটি ছবিতে কঙ্কালসার এক ব্যক্তির 'স্টাফ' করা মাথা দেখা যায় আর অন্য ছবিটিতে দেখা যায় সতেজ-ত্বকের এক মানুষ। যার মাথায় রয়েছে দুদিকে দুই মুখ।
স্টাফ করা মাথাটির নীচে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ''এডওয়ার্ড মরড্রেক-এর মাথা, উত্তরপুরুষদের জন্য সংরক্ষণ করেছেন ড. পি মানভেরস।'' (ইংরেজিতে মূল লেখা: Head of Edward Mordrake, preserved for posterity by Dr. P. Manvers)
ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ও গ্রুপে ছবিদুটি শেয়ার করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, ''একজন হতভাগ্য মানুষ এডওয়ার্ড মরড্রেক। "এডওয়ার্ড মরড্রেক বা এডওয়ার্ড মরডেক।'' ১৯ শতকের ইংরেজ অভিজাত মানুষ এডওয়ার্ড মরডেক। ঊনিশ শতকে জন্ম নেয়া একজন হতভাগ্য মানুষ, যে দু'টো মাথা নিয়ে জন্মেছিলো। সাধারণ মানুষের চেহারা কেবল সামনের দিকেই থাকে, অথচ এই মানুষটার মাথার পেছনেও আর একটা চেহারার অস্তিত্ব ছিলো। সেই অস্তিত্বটা হাসতো, কাঁদতো আর উদ্ভট উদ্ভট শব্দ করতো। এবং এডওয়ার্ডের কোন কন্ট্রোল ছিলো না ঐ মাথাটার ওপর! সে নিজেই একটা আলাদা অস্তিত্ব হয়ে উঠেছিলো। এডওয়ার্ডের ধারণা ছিলো এটা ''শয়তানের মাথা।'' রাতের বেলা যখন এডওয়ার্ড ঘুমাতে যেতো, তখন ঐ বাড়তি জিনিসটা নাকি ফিসফিস করে কিছু একটা বলতো তাকে! ডাক্তারদের বার বার অনুরোধ করা হয়েছিলো বাড়তি মাথাটা কেটে ফেলার জন্যে, কিন্তু কেউ সাহস করে উঠতে পারেনি। এবং মাত্র ২৩ বছর বয়সে যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে এডওয়ার্ড আত্নহত্যা করে বসে।''
একই বয়ানে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ছবিগুলি শেয়ার করা হচ্ছে। এরকম দুটি পোস্ট আর্কাইভ করা আছে এখানে ও এখানে।
তথ্য যাচাই
বুম যাচাই করে দেখে ভাইরাল ছবিগুলি কাল্পনিক শিল্পকর্ম। যার নেপথ্যে রয়েছে এক মগগড়া গল্পের বই ''অ্যানোমালিস অ্যান্ড কিউরিয়োসিটিস মেডিসিন (Anomalies and Curiosities of Medicine)।'' ১৮৯৬ সালের প্রকাশিত বইটি লেখেন আমেরিকার দুই ডাক্তার জর্জ এম গোল্ড ও ওয়াল্টার এল. পিলি। এই বইটিতে মেডিকেলের বিভিন্ন আজগুবি ঘটনা সত্যকাহিনীর আকারে বলা আছে। যা মূলত এক ধরণের কাল্পনিক গল্প।
২৩ বছর বয়সে এডওয়ার্ড মরড্রেকের আত্মহত্যা করার ওই গালগল্প এই বই থেকে নেওয়া।
কল্পকাহিনী নাকি সত্যি?
বুম এডওয়ার্ড মরড্রেক নামে কিওয়ার্ড সার্চ করে 'মিউজিয়াম অফ হোয়াক্স' hoaxes.org এর সন্ধান পায়। ১৯৯৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে এই ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক অ্যালেক্স বোয়েসি। ওই ওয়েবমিউজিয়ামের কাজ মূলত অতীত-বর্তমানের গুজব ও আর্বান লেজেন্ড নিয়ে আলোচনা করা। আর্বান লেজেন্ড হল এক ধরণের ভয়, নীতি ও কৌতুকমূলক কাহিনী যার কোনও উৎস বা ভিত্তি নেই।
'মিউজিয়াম অফ হোয়াক্স' এর ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় জর্জ এম গোল্ড ও ওয়াল্টার এল. পিলি-এর গল্পের উৎস কবি চার্লস লোটিন হিল্ডডার্থ এর ১৮৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর বস্টন সান্ডে পোস্টে-এ প্রকাশিত একটি গল্প। যা আবার ''অ্যানোমালিস অ্যান্ড কিউরিয়োসিটিস মেডিসিন'' বই প্রকাশের এক বছর আগের ঘটনা। চার্লস লোটিন হিল্ডডার্থ-এর ওই গল্প তার কদিন পরে আরও দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অ্যালেক্স বোয়েসি newspapers.com থেকে সার্চ করে খুঁজে বের করেছেন ১৯ শতকের সংবাদপত্রের এই সব তথ্য।
চার্লস লোটিন হিল্ডডার্থ তার গল্পে 'রয়াল সাইন্টিফিক সোসাইটি'র কথা উল্লেখ করেছে। বাস্তবে এই ধরণের কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না সে সময়। তবে কি নাম ভুল করে রয়াল সোসাইটি অফ লন্ডনের কথা বলা হয়েছে? রয়াল সোসাইটি অফ লন্ডনের নথি সার্চ করে কোনও হদিস পায়নি 'মিউজিয়াম অফ হোয়াক্স।'
সে সময় সত্যকথন বলে কাগজে ছাপা মনগড়া কাহিনী পরে এডওয়ার্ড মরড্রেকের আর্বান লেজেন্ডের রূপ নেয়।
কঙ্কাল না শিল্প?
বিজ্ঞান সাংবাদিক ক্রিস্টিন হুগোর ২০১৫ সালের নিউজ উইকের প্রতিবেদন খুঁজে পায়। ওই প্রতিবেদনে 'স্টাফ' করা ছবিটির সৌজন্য হিসেবে ইওয়ার্ট সিডেলের এর নাম উল্লেখ করা আছে। ডেভিয়ান আর্ট ওয়েবসাইট ছবিটিকে ইওয়ার্ট সিডেলের-এর শিল্পকর্ম বলে উল্লেখ করেছে। ফেসবুক প্রোফাইল অনুসারে ইওয়ার্ট সিডেলের ব্রিটেনের প্রাইমাউথ কলেজ অফ আর্ট-এর প্রাক্তন ছাত্র।
বুমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান ''এডওয়ার্ড মরড্রেক এর মাথা- ইওয়ার্ট সিডেলের'' (ইংরেজিতে ক্যাপশন: The Head of Edward Mordrake - Ewart Shindler) নামে এই শিল্পকর্মটি তিনি বেশ কিছু বছর আগে তৈরি করেন।
ইওয়ার্ট সিডেলের এই ধরণের পেপার ম্যাচে (papier-mâché) ভাস্কর্য করে থাকেন। কুচো কাগজের মন্ড আঠা দিয়ে জুড়ে তৈরি করা হয় পেপার মাচে ভাস্কর্য।
'মিউজিয়াম অফ হোয়াক্স'- দ্বিতীয় ছবিটিকে সম্ভবত কোনও মোমের মিউজিয়ামের মূর্তি বলে দাবি করেছে। বুমের পক্ষে ছবিটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
পপুলার কালচার ও এডওয়ার্ড মরড্রেক
এই কল্পকাহিনীকে নিয়ে টম ওয়েটস গান বেঁধেছেন 'চেইন টুগেদার ফর লাইফ।' এরলিং ওরার্লড-এর নাটক রেয়েছে 'মরড্রেক' নামে। 'আমেরিকান হরর স্টোরি: ফ্রিক শো' নামে টিভি সিরিজেও এডওয়ার্ড মরড্রেককে দেখা গেছে চরিত্র হিসেবে। এই নামে নাকি এক মুভিও তৈরি হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
বিষয়টি নিয়ে স্নপস ও রয়টর্সের প্রতিবেদন পড়া যাবে এখানে ও এখানে।
শিল্পকর্ম বিভিন্ন সময়ে ভুয়ো খবরে ইন্ধন জুগিয়েছে। স্পেনের শিল্পকর্মের ভিডিওকে এক তামিল রাজনীতিকের লুকনো টাকার ছবি কিংবা নেপালের হাইকু পাখি বা অলৌকিক প্রাণী বলে ভাইরাল হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের গহন কালো সৌন্দর্য কি গিনেস বুকে নাম তুললো? ভুয়ো পোস্ট ভাইরাল