একটি ভাইরাল টুইটে দাবি করা হয়েছে চিনা গণতন্ত্রকামী ও ভিন্নমতাবলম্বী কর্মী জিয়ানলি ইয়াং স্বীকার করেছেন যে, জুন মাসে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে শতাধিক চিনা সেনা মারা যান। দাবিটি ভুয়ো এবং এই খবরের সূত্র অজ্ঞাত কিছু ওয়েবসাইট।
গত ১৫-১৬ জুন তারিখে গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনাদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে একজন আধিকারিক সহ ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার ঘটনার এক মাসের মধ্যেই এই মিথ্যে দাবি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে, গালওয়ানের ঘটনাটি ছিল এই দুই পারমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত উত্তেজনার চরমতম নিদর্শন। চিনা বাহিনীও হতাহতের শিকার হয়, কিন্তু চিন মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। চিনের হতাহতের সংখ্যা সংক্রান্ত ভুল তথ্য বুম আগেও খারিজ করেছে। সে বিষয়ে এখানে ও এখানে পড়ুন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি লাদাখে যান ও সেখানে আহত জওয়ানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সোমবার বেশ কিছু টুইটার ব্যবহারকারী মিথ্যে দাবি করেন যে, জিয়ানলি ইয়াং চিনা পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বা গণমুক্তি ফৌজের একজন প্রাক্তন অফিসার, যিনি স্বীকার করেছেন যে, লাদাখের গালওয়ানে চিনা সেনাদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে অজানা এক ওয়েবসাইট থেকে খবর শেয়ার করেন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা কপিল মিশ্র এবং আরও অনেকে, যেমন ঋষি বাগরি ও নিউজলাইন আইএফই।
ভাইরাল দাবিতে বলা হয়, "গালওয়ান উপত্যকায় শতাধিক চিনা সেনা মারা গেছে।" কেউ কেউ আবার তার সঙ্গে জুড়ে দেন যে, খবরটি দিয়েছেন 'একজন চিনা সামরিক কর্তা' এবং ইয়্যাংকে চিন সেনাবাহিনীর এক সদস্য বলে তাঁর মিথ্যে পরিচয় দেওয়া হয়।
টুইটটির আর্কাইভ সংস্করণ
এখানে দেখুন।
আর্কাইভ দেখতে
এখানে ক্লিক করুন।
নিউজলাইন আইএফই, হল একটি অজ্ঞাতনামা টুইটার হ্যান্ডেল যেটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করে থাকে। সেটিও ওই দাবি শেয়ার করে। বুম আগেও নিউজলাইন আইএফই-র ছড়ানো মিথ্যে খবর ফাঁস করে দেয়। সে বিষয়ে
এখানে পড়ুন।
নিউজ-এক্স তাদের এক সম্প্রচারে ভুয়ো খবরটি দেয়। তাতে বলা হয়, "১০০-রও বেশি চিনা গালওয়ানে নিহত, অভিজ্ঞ পিএলএ সদস্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য।" অ্যাঙ্কার ইয়াংকে চিনা সেনা হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন, "শতাধিক চিনা সেনা মারা যান।"
আর্কাইভ দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
ফেসবুক পেজ 'নেশন উইথ নামো' নিউজ-এক্স এর ভিডিওটি তুলে নিয়ে ওই ফেসবুক পেজ থেকে ব্যাপক ভাবে শেয়ার করে।
আর্কাইভ এখানে দেখুন।
আরও পড়ুন: ভারত বায়োটেকের ভিপি 'কোভ্যাক্সিন' নিচ্ছে, ভাইরাল দাবি নস্যাৎ সংস্থার
তথ্য যাচাই
বুম কোনও বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ ওয়েবসাইটের সন্ধান পায়নি যেখানে গালওয়ান সংঘর্ষে ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনা মারা গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমরা লক্ষ করি যে, বেশিরভাগ পোস্টেই কোনও সংবাদ মাধ্যমের উল্লেখ নেই। কিছু পোস্টে অবশ্য খবরটির সূত্র হিসেবে 'ওয়াশিংটন টাইমস' কাগজে একটি প্রকাশিত মতামতকে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সেই লেখায় ওই ধরনের কোনও দাবি করা হয়নি।
তাতে অবসরপ্রাপ্ত চিনা সেনা কর্তাদের মধ্যে অসন্তোষের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোথাও বলা হয়নি যে, ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনা ওই সংঘর্ষে মারা যান।
আমরা প্রথমে যাচাই-না-করা ওয়েবসাইটগুলি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাই। সেগুলিই ওই খবরটি প্রকাশ করেছিল এবং তা টুইটারে ব্যাপক হারে শেয়ার করা হয়।
প্রত্যক্ষ নিউজকাস্ট
বহুভাষী ওয়েবসাইট 'প্রত্যক্ষ নিউজকাস্ট' ৩ জুলাই খবরটি প্রকাশ করে। তার শিরোনামে বলা হয়, "ভারত গালওয়ান উপত্যকায় ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনাকে নিহত করেছে, দাবি করেছেন একজন প্রাক্তন চিনা সেনা কর্তা।"
ওয়াশিংটন টাইমস-কে উদ্ধৃত করে ওই লেখায় বলা হয়, "প্রাক্তন চিনা সামরিক অফিসার ও চিন কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতার ছেলে জিয়ানলি ইয়াং এক চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন। ইয়াং এর কথা অনুযায়ী, '১৫ জুন রাতে, ভারতীয় আর চিনা সেনাদের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে, ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনা মারা যান। কিন্তু চিনা কর্তৃপক্ষ চিনের জনগণের কাছ থেকে সেই তথ্য গোপন করছে। প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের আশঙ্কা যে, গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনাদের নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে, চিনের কর্মরত ও প্রাক্তন সেনারা বিদ্রোহ করতে পারেন।"
মহারাষ্ট্র থেকে 'প্রত্যক্ষ' নামের প্রকাশনাটি চালান ড. অনিরুদ্ধ যোশী নামের এক ব্যক্তি। এবং সেটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন যিনি, তাঁর নাম সমীরসিং দত্তপাধ্যায়। বুম দত্তপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেই এই প্রতিবেদন আপডেট করা হবে।
লেখাটি দেখতে
এখানে ক্লিক করুন; আর্কাইভ দেখতে
এখানে।
ক্রিয়েটলি
বিজেপি নেতা ও আরও অনেক টুইটার হ্যান্ডেল '
ক্রিয়েটলি'তে প্রকাশিত লেখাটি শেয়ার করেছেন। লেখাটির শিরোনামে বলা হয়, "গালওয়ান উপত্যকায় ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনা নিহত হন: চিনা সামরিক অফিসারের স্বীকারোক্তি।"
ক্রিয়েটলি এর প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট
যা দাবি করা হয়েছে, ক্রিয়েটলি-র খবরও সেই একই ধরনের। কিন্তু ওয়াশিংটন টাইমস বা অন্য কোনও সূত্রের উল্লেখ করা হয়নি সেখানে। ক্রিয়েটলি ওয়েবসাইটটি দেখলেই বোঝা যায় যে, তাতে যে কেউ নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে লেখা প্রকাশ করতে পারেন।
ক্রিয়েটলিতে প্রকাশিত লেখাটি ভুলে ভরা। ইয়াং এর নামের বানান ভুল হয়েছে বারবার। জিয়ানলি ইয়াং লেখার বদলে কখনও তা লেখা হয়েছে 'ইয়াং জিনালি', অথবা 'গিয়ানলি'। তাছাড়া, যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যেও অসঙ্গতি লক্ষনীয়। যেমন, কখনও ইয়্যাংকে সেনা অফিসার বলা হয়েছে, আবার কোথাও বলা হচ্ছে প্রাক্তন অফিসার। কোথাও তাঁর বাবাকে চিন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বলা হয়েছে, তো অন্যত্র বলা হয়েছে প্রাক্তন নেতা।
ক্রিয়েটলিতে প্রকাশিত লেখাটির আর্কাইভ সংস্করণ
এখানে দেখুন।
কে এই জিয়ানলি ইয়াং এবং তিনি কি বলেছেন গালওয়ানে ১০০ জনেরও বেশি চিনা সেনা মারা গেছেন?
জিয়ানলি ইয়াং হলেন একজন ভিন্নমতাবলম্বী চিনা এবং চিন কমিউনিস্ট পার্টির এক প্রাক্তন নেতার ছেলে। বর্তমানে উনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। '
সিটিজেন পাওয়ার ইনিসিয়েটিভ ফর চায়না' নামে তাঁর একটি সংগঠন আছে, যার মাধ্যমে উনি মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজ করেন।
২৯ জুন ২০২০ তারিখে, ওয়াশিংটন টাইমস ইয়াং এর একটি মতামতধর্মী লেখা প্রকাশ করে। সেটির শিরোনাম ছিল, 'প্রাক্তন ও ব্যথিত পিএলএ সেনানীরা চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের বিরুদ্ধে একটি শক্তি হয়ে উঠতে পারে।' লেখাটিতে চিনা সেনাবাহিনীর প্রাক্তনীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কথা বলা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, পেনশন ও অন্যান্য সুবিধের ব্যাপারে তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছেন।
ওই একই লেখায়, ইয়াং চিনা বাহিনীর হতাহতের কথা উল্লেখ করেন। উনি বলেন, "ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও, তাদের দিকেও যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, সে কথা চিন প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি...।" এবং এ প্রসঙ্গে চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানের একটি সাংবাদিক সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে ইয়্যাং বলেন, গালওয়ান সংঘর্ষে কতজন চিনা সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন ঝাও।
বুম ওয়াশিংটন টাইমস-এ প্রকাশিত লেখাটি পড়ে দেখে। তাতে ইয়াং কোথাও বলেননি যে গালওয়ান সংঘর্ষে ১০০ বা ১০০-র বেশি চিনা সেনা মারা যান। পুরো লেখাটিতে ইয়াং এক বারও ১০০ চিনা সেনা নিহত হওয়ার কথা লেখেননি।
একটি মাত্র ক্ষেত্রে ইয়াং চিনা হতাহতের একটা সংখ্যা উল্লেখ করেন। ঝাও-এর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উনি বলেন যে, ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্টে ৪০ চিনা সেনা মারা গিয়েছেন বলে দাবি করা হয়, কিন্তু ঝাও সেটিকে "মিথ্যে তথ্য" বলে উড়িয়ে দেন।
ইয়াং এর পুরো লেখাটি
এখানে পড়ুন। বুম ওয়াশিংটন টাইমস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারলেই এই প্রতিবেদন আপডেট করা হবে।
আমরা ইয়াং এর টুইটার অ্যাকাউন্টও খুঁটিয়ে দেখি। কিন্তু আমরা এমন কোনও টুইট দেখতে পাইনি যেখানে গালওয়ান সংঘর্ষে ১০০ চিনা সেনা মারা গেছেন বা ভারতীয়রা তাঁদের মেরে ফেলেছেন বলেছে দাবি করা হয়েছে।